অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন: সম্ভাব্য প্রেক্ষিতে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ

বিল্লাল বিন কাশেম:
বাংলাদেশের ইতিহাসে গণঅভ্যুত্থান সবসময়ই নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। প্রতিটি গণজাগরণের পর দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নতুন পথের সন্ধান পেয়েছে। সর্বশেষ গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তীতে বাংলাদেশ আবারও এক নতুন বাস্তবতায় প্রবেশ করছে, যেখানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য নতুন কৌশল ও নীতিমালা নির্ধারণ করা অপরিহার্য। এই পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে আমরা কীভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারি, তা নিয়ে গভীর পর্যালোচনা প্রয়োজন।
অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা
গণঅভ্যুত্থানের ফলে সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, যা বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর নীতির মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করা সম্ভব। নতুন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ:
শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান: স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ এবং প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্পায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।
কৃষির আধুনিকায়ন: কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থা ও টেকসই কৃষিনীতির মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ তৈরি হবে।
বিদেশি বিনিয়োগ ও রপ্তানি বৃদ্ধি: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে শুধু পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল না থেকে তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধ ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে প্রসারিত করতে হবে।
অর্থনৈতিক নীতিমালার সংস্কার: করব্যবস্থার স্বচ্ছতা, ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ও দুর্নীতি দমন নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন।
নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনুসের পদক্ষেপ:
অর্থনৈতিক উন্নয়নে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের অবদান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর “গ্রামীণ ব্যাংক” ও “সোশ্যাল বিজনেস” মডেল বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, সৃজনশীল উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা মনোভাব দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য কার্যকর উপায় হতে পারে।
ড. ইউনুসের মতে, গ্রামীণ অর্থনীতি এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সমর্থন করে সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব। তাঁর বিভিন্ন উদ্যোগ, যেমন মাইক্রোক্রেডিট, ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক উদ্যোগ এবং নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত প্রোগ্রামগুলি বাংলাদেশের সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে ক্ষুদ্র জনগণের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি দেশে ন্যায্যতা ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
সামাজিক উন্নয়ন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান চাওয়া হলো ন্যায়বিচার ও সামাজিক সমতা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা না গেলে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনায় নিতে হবে:
শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন: নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য শিক্ষার মানোন্নয়ন অপরিহার্য। কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার বিস্তৃতি ঘটিয়ে তরুণদের দক্ষ করে তুলতে হবে, যাতে তারা আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে।
সামাজিক ন্যায়বিচার: বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা দূর করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন করতে হবে।
নারী ও যুব উন্নয়ন: নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি যুব সমাজের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য স্টার্টআপ ও উদ্যোক্তা সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করতে হবে।
সুশাসন ও দুর্নীতি দমন: গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে হলে দুর্নীতি দমন করা আবশ্যক। প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে ডিজিটাল ব্যবস্থা ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
পরিশেষে
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করতে হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে সমান্তরালে এগিয়ে নিতে হবে। অধ্যাপক ড. ইউনুসের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে সামাজিক ব্যবসার মডেলগুলো অব্যাহত রাখলে, বাংলাদেশের উন্নয়ন অনেক বেশি স্থায়ী ও সমন্বিত হতে পারে। স্বচ্ছ নীতিমালা, কার্যকর নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। এখন সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণের, সময় নতুন বাংলাদেশ গড়ার।
লেখক: কবি, লেখক ও কলামিস্ট