ঈদের গল্প: প্রলোভন আর প্রতারণার জালে

বিল্লাল বিন কাশেম: আনিকা ইনান একসময় ভেবেছিল প্রেম মানেই রঙিন গল্প, সিনেমার মতো রোমান্স, না পাওয়ার বেদনা আর একে অপরের জন্য পাগলামি। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
টনটন নামের একটি ডেটিং অ্যাপে প্রায়ই সময় কাটাতো সে। প্রথম দিকে শুধুই মজা করার জন্য ব্যবহার করত, কিন্তু ধীরে ধীরে এটা তার জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। একটার পর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে, আবার ভেঙেও যায়। কোথাও যেন এক ধরণের শূন্যতা অনুভব করত সে, যা কোনো সম্পর্কই পূরণ করতে পারছিল না।
একদিন অ্যাপে পরিচয় হলো নাহিয়ান আহমেদের সঙ্গে। নাহিয়ান শুধু সুদর্শনই নয়, বরং আত্মবিশ্বাসী, বুদ্ধিদীপ্ত একজন মানুষ। তার পরিচয় ছিল একজন লেখক ও উদ্যোক্তা হিসেবে। অনলাইনে কথা বলতে গিয়েই আনিকার মনে হলো, এই মানুষটা অন্যদের চেয়ে আলাদা। সে আনিকাকে সহজ-সরল ভাষায় বোঝাতে লাগল জীবন ও সম্পর্কের আসল দিকগুলো।
২
প্রথম কয়েকদিন চ্যাট, তারপর ভিডিও কল— ধীরে ধীরে তাদের আলাপ ঘনিষ্ঠ হতে লাগল। নাহিয়ানের সঙ্গে কথা বলার সময় আনিকা নিজেকে অন্যরকম লাগত। তার সঙ্গে কথা বললে মনে হতো, সে কেবল শরীরের জন্য নয়, বরং তার মনের গভীরতা বুঝতে চায়।
নাহিয়ান কখনোই তাড়াহুড়া করত না। অন্য ছেলেদের মতো সে প্রেম-ভালোবাসার বিষয়ে বাড়াবাড়ি করত না, বরং সম্পর্ককে সময় দিতে চাইত। একদিন আনিকা প্রশ্ন করল,
— “তুমি কি বিশ্বাস কর, সত্যিকারের প্রেম এখনো বেঁচে আছে?”
নাহিয়ান একটু হেসে বলল,
— “প্রেম সবসময় ছিল, আছে, থাকবে। শুধু আমরা এখন প্রেমকে নিয়ে বেশি খেলি, তাই সেটা আর গভীর হয় না।”
এই কথাটা আনিকাকে ভাবিয়ে তুলল। সে নিজেও জানত, তার সম্পর্কগুলো গভীর হয়নি, কারণ সে নিজেই কখনো সত্যিকারের ভালোবাসার মূল্য বোঝেনি।
৩
কিন্তু তার পুরোনো স্বভাব সহজে পাল্টানোর নয়। একদিন নাহিয়ানকে এড়িয়ে অন্য একটি অ্যাপে ঢুকল। সেখানে এক বিদেশি যুবকের সঙ্গে কথা বলা শুরু করল। সে খুব প্রশংসা করছিল আনিকার সৌন্দর্যের, তার ছবি নিয়ে কথা বলছিল। আনিকা বুঝতে পারছিল, এও আগের মতোই একটা মোহের খেলা।
কিন্তু সে নিজেকে আটকাতে পারছিল না। মোহের এই ফাঁদে সে বারবার পড়েছে, আবার বের হয়ে গেছে। নতুন নতুন মানুষ, নতুন উচ্ছ্বাস, নতুন অনুভূতি— এসবের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল সে।
কিছুদিন পর নাহিয়ান বুঝতে পারল, আনিকা দ্বিধাগ্রস্ত। সে জিজ্ঞেস করল,
— “তুমি কি আসলেই নিজের সুখ খুঁজে পেয়েছ?”
আনিকা বলল না কিছু। সত্যি বলতে, সে নিজেই জানত না সে কী চায়।
৪
একদিন গভীর রাতে আনিকার মনে হলো, এসব সম্পর্ক তার জন্য কিছুই এনে দেয়নি। যে মানুষগুলোকে সে আপন ভেবেছিল, তারা কেবলই নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্য ছিল। শুধু নাহিয়ানই ব্যতিক্রম।
সে নাহিয়ানকে মেসেজ করল,
— “আমি কি তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারি?”
নাহিয়ান কিছুক্ষণ পর উত্তর দিল,
— “হ্যাঁ, কাল বিকেলে।”
পরদিন আনিকা একটা ক্যাফেতে গেল। নাহিয়ান তাকে দেখে একটু হেসে বলল,
— “তুমি পালাতে চেয়েও পালাতে পারোনি, তাই না?”
আনিকা চোখ নিচু করল।
— “আমি বুঝতে পেরেছি, জীবনে সবচেয়ে বড় ফাঁদ হলো নিজের মোহ। আমি এতদিন কেবলই একটার পর একটা সম্পর্ক খুঁজেছি, কিন্তু আসলে আমি নিজেকেই খুঁজছিলাম।”
নাহিয়ান একটু থেমে বলল,
— “প্রেম বা সম্পর্ক তোমার জীবনকে পূর্ণতা দিতে পারবে না, যতক্ষণ না তুমি নিজে নিজের মূল্য বোঝো।”
আনিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে জানত, এবার সময় এসেছে নিজের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা দেখানোর, নতুন করে বেঁচে থাকার।
নতুন ভোরের পথে সে এবার সত্যিকারের পথিক হতে চায়।
লেখক: কবি ও গল্পকার