
আহমেদ সেহেল
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সাবেক শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতির পটভূমিতে একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর মাধ্যমে জনগণ এক নতুন পথে হাঁটার সুযোগ পেয়েছে, কিন্তু এই বিপ্লবের পরবর্তী পরিস্থিতি ছিল অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, অপরাধের বিস্তার এবং জনগণের নিরাপত্তাহীনতা বর্তমান সংকটের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে একটি শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজন, যার মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে নেতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তিনি হলেন নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। তাঁর নেতৃত্বে আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
২০২৪ গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী আইন শৃঙ্খলার অবনতি
গণঅভ্যুত্থান ২০২৪, যেখানে ছাত্র-জনতা নেতৃত্ব দিয়েছিল, দেশে একটি নতুন সূর্যের আলো আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে, বর্তমান সরকারের পতনের পরপরই, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে এবং অপরাধপ্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষত রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য প্রধান শহরে ছিনতাই, ডাকাতি, ইত্যাদি অপরাধের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত, এবং জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি গভীর হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক শান্তি বাধাগ্রস্ত হবে।
ড. ইউনুসের নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দেশের স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্ব অত্যন্ত জরুরি। তার যাত্রা শুরু হয়েছিল দারিদ্র্য দূরীকরণের মাধ্যমে, আর তার কর্মজীবন কখনোই জনগণের কল্যাণের বিপরীতে ছিল না। এমন একজন নেতা, যিনি মানবাধিকার, সততা এবং স্বচ্ছতার পক্ষে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তিনি দেশের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের জন্য আদর্শ।
ড. ইউনুসের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সংস্কার সম্ভব, কারণ তিনি মানবিক মূল্যবোধের প্রতি অনুগত একজন নেতা। তাঁর পথচলার মাধ্যমে বাংলাদেশে এক নতুন শৃঙ্খলা, ন্যায্যতা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং জনগণের নিরাপত্তা
বাংলাদেশের ব্যবসায়ী মহল বর্তমানে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। ছিনতাই, ডাকাতি এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ব্যবসায়ীদের জন্য বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্ব হল ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে তারা নিজের কাজের প্রতি আস্থা রাখতে পারে।
১. ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা: ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা তাদের ব্যবসা নির্বিঘ্নে পরিচালনা করতে পারেন।
২. সততার পুরস্কৃত করা: যেসব ব্যবসায়ী সততার সঙ্গে কাজ করছেন, তাদের পুরস্কৃত করতে হবে। এভাবে একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি হবে।
৩. আইনগত কাঠামো: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা এবং একটি সুষ্ঠু আইনি কাঠামো ব্যবসায়ীদের জন্য সবচেয়ে বড় আশ্বাস হতে পারে।
রাজনৈতিক বিভক্তি দূর করা এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একাধিকবার জনগণের বিপ্লব সংঘটিত হলেও তা রাজনৈতিক দলের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান উভয়ই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ছিল, কিন্তু পরে তা রাজনৈতিক অপব্যবহার হয়েছে।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অপরকে একনিষ্ঠভাবে খণ্ডিত করে রেখেছে এবং এর ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ আরো বিপর্যস্ত হয়েছে। সময় এসেছে, এই বিভাজন কাটিয়ে উঠতে এবং দেশের জন্য সত্যিকারের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে। ড. ইউনুসের নেতৃত্বে রাজনৈতিক আস্থা তৈরি হতে পারে, এবং সবাই একত্রে দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে পারেন।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ: একত্রে কাজ করা এবং উন্নয়ন
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠিত হবে ঐক্য ও সমন্বয়ের মাধ্যমে। সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক শ্রেণি এবং জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিভক্তির রাজনীতি অবসান করতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থে সকলকে একত্রিত করতে হবে।
১. জাতীয় ঐক্য: সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী এবং জনগণকে একত্রিত হতে হবে, যাতে জাতি একযোগে উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে।
২. সুস্থ গণতন্ত্র: একদলীয় শাসনব্যবস্থা ও দমনমূলক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৩. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: দেশের আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়ে যাবে, চাকরি সৃষ্টি হবে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, তবে এই বিপ্লবের পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলোকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ব্যবসায়ী মহলের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। এই কাজে নেতৃত্বের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনুসের মতো একজন সৎ এবং অভিজ্ঞ নেতা প্রয়োজন। তাঁর নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তবেই, দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে এবং একটি নিরাপদ, স্থিতিশীল এবং উন্নত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।