শবে কদর: ফজিলত, গুরুত্ব ও আমাদের করণীয়

বিল্লাল বিন কাশেমঃ শবে কদর বা ‘লাইলাতুল কদর’ ইসলামের এক মহান ও বরকতময় রাত। পবিত্র কুরআনে এই রাতকে ‘হাজার মাসের চেয়ে উত্তম’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই রাতে মহান আল্লাহ তার অশেষ রহমত ও মাগফিরাত দিয়ে মুসলমানদের জীবন আলোকিত করেন। এটি রমজান মাসের শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে একটি, বিশেষ করে ২১, ২৩, ২৫, ২৭ বা ২৯তম রাতে পাওয়া যেতে পারে। শবে কদরের তাৎপর্য, ফজিলত ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আমাদের অবশ্যই কুরআন ও হাদিসের দিকে তাকাতে হবে, কারণ এই দুটি উৎসেই এ রাতের মর্যাদা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
শবে কদরের ফজিলত ও গুরুত্ব
১. শবে কদর: হাজার মাসের চেয়ে উত্তম
শবে কদরের গুরুত্ব সম্পর্কে সর্বপ্রথম আলোচনা পাওয়া যায় পবিত্র কুরআনের সূরা আল-কদরে। মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ
“নিশ্চয়ই আমি একে (কুরআন) নাজিল করেছি কদরের রাতে। তুমি কি জানো, কী সেই কদরের রাত? কদরের রাত হলো হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।”
(সূরা আল-কদর: ১-৩)
এই আয়াতে শবে কদরের যে বিশাল মর্যাদার কথা বলা হয়েছে, তা বোঝার জন্য ‘হাজার মাসের চেয়ে উত্তম’ বাক্যের অর্থ অনুধাবন করা জরুরি। যদি আমরা গাণিতিকভাবে হিসাব করি, তাহলে দেখা যায় এক হাজার মাস প্রায় ৮৩ বছর ৪ মাসের সমান, যা মানুষের গড় আয়ুর প্রায় সমান। অর্থাৎ, যদি কেউ শবে কদরে সৎকর্মে লিপ্ত থাকে, তবে সে যেন তার পুরো জীবনের ইবাদতের সমান সওয়াব লাভ করে!
২. কুরআন নাজিলের রাত
শবে কদরের আরেকটি বিশেষ ফজিলত হলো, এই রাতে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ
“নিশ্চয়ই আমি একে (কুরআন) এক বরকতময় রাতে নাজিল করেছি। নিশ্চয়ই আমরা সতর্ককারী।”
(সূরা আদ-দুখান: ৩)
কুরআন মানবজাতির মুক্তির দিশারি, আর সে কুরআন যখন নাজিল হয়েছে, সেই রাত কতই না মহিমান্বিত! এই রাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা ফেরেশতাদের মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি, রহমত ও কল্যাণ বর্ষণ করেন।
৩. ফেরেশতাদের আগমন ও শান্তির বার্তা
শবে কদরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এ রাতে অসংখ্য ফেরেশতা পৃথিবীতে আগমন করেন এবং মুমিনদের ওপর আল্লাহর রহমত ও শান্তির বার্তা পৌঁছে দেন। কুরআনে বলা হয়েছে:
تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ سَلَامٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطْلَعِ الْفَجْرِ
“এ রাতে ফেরেশতারা ও রূহ (জিবরাঈল আ.) প্রতিপালকের নির্দেশক্রমে প্রত্যেক কাজে অবতীর্ণ হন। এটি শান্তিময় রাত, ফজরের উদয় পর্যন্ত।”
(সূরা আল-কদর: ৪-৫)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, শবে কদর শুধু ইবাদতের রাত নয়, বরং এটি শান্তিরও রাত। সারা পৃথিবীতে এই রাতে আল্লাহর অশেষ রহমত বর্ষিত হয়।
শবে কদরের রাতের করণীয়
১. ইবাদতে মশগুল থাকা
শবে কদরের মূল সৌন্দর্য নিহিত রয়েছে ইবাদতের মধ্যে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি শবে কদরে ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় ইবাদত করবে, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।”
(সহিহ বুখারি: ২০১৪, সহিহ মুসলিম: ৭৬০)
এই রাতে আমাদের উচিত নামাজ আদায় করা, কুরআন তিলাওয়াত করা, দোয়া করা এবং আল্লাহকে স্মরণ করা।
২. বেশি বেশি দোয়া করা
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) নবীজি (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন:
“হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি জানতে পারি যে শবে কদর কখন, তাহলে আমি কোন দোয়া পড়ব?”
নবীজি (সা.) তাকে এই দোয়া পড়তে বলেছেন:
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
“হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসো, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
(তিরমিজি: ৩৫১৩, ইবনে মাজাহ: ৩৮৫০)
এই দোয়াটি বারবার পড়া উচিত, কারণ আল্লাহর ক্ষমা ব্যতীত আমাদের মুক্তি নেই।
৩. তওবা ও ইস্তিগফার করা
শবে কদর ক্ষমার রাত। তাই এ রাতে আমাদের আন্তরিক তওবা করা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“আল্লাহ তার বান্দার তওবা কবুল করতে এত বেশি আনন্দিত হন, যতটা একজন হারিয়ে যাওয়া উট ফিরে পেলে খুশি হয়।”
(সহিহ মুসলিম: ২৭৪৭)
আমরা যদি সত্যিকারের অনুশোচনার সাথে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, তাহলে তিনি আমাদের সব পাপ ক্ষমা করে দেবেন।
৪. দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য করা
শবে কদরে সাদকাহ (দান) করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। রাসূল (সা.) বলেছেন:
“দান-সাদকা গুনাহকে নিভিয়ে দেয়, যেমন পানি আগুন নিভিয়ে দেয়।”
(তিরমিজি: ৬১৪)
এই রাতে যারা দান করে, তারা যেন হাজার মাস দান করার সওয়াব লাভ করে!
শবে কদরের শিক্ষা: আমাদের জীবন পরিবর্তন
শবে কদর শুধু একটি রাতের ইবাদত নয়; বরং এটি আমাদের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ। এই রাতে আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করি, দোয়া করি, তওবা করি এবং নিজেদের আত্মশুদ্ধি করি। কিন্তু এই শিক্ষা শুধু এক রাতের জন্য নয়—বরং সারাজীবনের জন্য হওয়া উচিত।
আমাদের উচিত শবে কদরের শিক্ষা অনুযায়ী জীবনে পরিবর্তন আনা। শুধু এক রাতের জন্য নয়, বরং সারাবছর আমাদের ইবাদতের প্রতি মনোযোগী হওয়া দরকার। আমাদের জীবনে আল্লাহভীতি, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠতা বজায় রাখা উচিত।
শবে কদর আমাদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশাল নিয়ামত। এটি ক্ষমা, রহমত ও বরকতের রাত। এই রাতকে আমরা কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া, ইস্তিগফার, ইবাদত ও সাদকা দ্বারা কাটালে, আমাদের অতীতের গুনাহ ক্ষমা হয়ে যাবে এবং আমরা জান্নাতের পথে এগিয়ে যাব।
আসুন, আমরা সবাই এই রাতের ফজিলত বুঝে আমল করি এবং নিজেদের জীবনকে শবে কদরের শিক্ষায় পরিবর্তিত করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই বরকতময় রাতের পূর্ণ ফজিলত লাভের তাওফিক দান করুন—আমিন!
লেখক: গণসংযোগ কর্মকর্তা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন