
ইশতিয়াক আহমদ মাসুমঃ সবকিছুই যেন ঘটেছিল এক ধরণের দম আটকে রাখা উত্তাপের বিস্ফোরণ হয়ে। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এককেন্দ্রিক এক শাসনের নীচে দাঁড়িয়ে ছিল চোখে-মুখে ক্ষোভ, বুকে জমে থাকা বিরক্তি আর মাথায় জমে থাকা প্রশ্ন নিয়ে।
১৫ বছর ক্ষমতার চূড়ায় থেকে শেখ হাসিনা একটা রাষ্ট্রকে নিজের ছাঁচে গড়ে তুলেছিলেন। প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, সেনাবাহিনী, নির্বাচন কমিশন সবই তার অনুগত; আর তার চারপাশে ভারত নামক পরাশক্তির একটা অদৃশ্য ছায়া যেন সর্বদা বিদ্যমান।
তবে ২০২৪ সালের আগস্টে সেই ছায়া ছিঁড়ে আকাশে এক বিদ্রোহী সূর্য ওঠে।
আভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণ: শেখ হাসিনার পতন
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা কেঁপে ওঠে। একদল তরুণ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা একজোট হয়। রাস্তায় নামে ছাত্র-জনতা। বহুদিনের অন্যায়ের হিসাব চাইতে চায় তারা।
রাজারবাগ, তেজগাঁও, ফার্মগেট, মতিঝিল, উত্তরা, যাত্রাবাড়ি সহ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। হঠাৎ করেই শেখ হাসিনা ও তার বিশ্বস্তদের একাংশ দেশ ছাড়ে। কেউ মালয়েশিয়া, কেউ ভারত, কেউ আবার নাম প্রকাশ না করে আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
ডা. ইউনূসের আগমন ও অন্তর্বর্তী সরকার
ঠিক এই সময়েই দৃশ্যপটে প্রবেশ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ৮ আগস্ট তিনি দেশে ফিরে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, তরুণ আন্দোলনকারী ও বেসামরিক প্রশাসনের কিছু অংশ নিয়ে নতুন এক সংবিধানিক রূপরেখা তৈরির কাজ শুরু হয়।
এক সমাবেশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন,
“দয়া করে আরও শত্রু তৈরি করবেন না। শান্ত থাকুন এবং দেশ গড়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন।”
তাঁর এই বক্তব্যে কেউ প্রশান্তি খুঁজে পেলেও, কেউ খুঁজে পেল হুমকি বিশেষ করে শেখ হাসিনা ও তার আঞ্চলিক বন্ধুদের চোখে।
ভারতের আতঙ্ক: প্রভাব হারানোর ভয়
নয়াদিল্লি তখন হতবাক। শেখ হাসিনা যে ভারতের “গ্যারান্টি দেওয়া বন্ধু” ছিলেন, সেটা কারো অজানা নয়।
মোদি সরকার বিশ্বাস করতো, হাসিনার মাধ্যমে তারা শুধু সীমান্ত নয়, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণেও ভূমিকা রাখতে পারবে। অথচ আজ সেই হাসিনা নেই তার জায়গায় একজন আন্তর্জাতিক সজ্জন, যার সঙ্গে দিল্লির দূরত্ব রয়ে গেছে।
সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং সেনাবাহিনীকে ‘অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি’ মোকাবেলার নির্দেশ দেন। বাংলাদেশ, গাজা, ইউক্রেন সবই একসঙ্গে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে।
দিল্লির শঙ্কা, বাংলাদেশের পরিবর্তন তাদের পূর্ব সীমান্তে একটি অনির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করবে, যার সুযোগ পাবে চীন ও পাকিস্তান।
সংখ্যালঘু ইস্যু: রাজনৈতিক হাতিয়ার না বাস্তব সংকট?
শেখ হাসিনার সমর্থনে সবচেয়ে সরব ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অংশ, যারা তাকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘অসাম্প্রদায়িক’ ভেবে সমর্থন করত।
কিন্তু পর্দার পেছনে কী ঘটেছে? ইউনূস সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের মিডিয়ায় দাবি ওঠে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নাকি ব্যাপক হামলা শুরু হয়েছে। মন্দির ভাঙচুর, দোকানপাটে আগুন, হিন্দু নেতাদের গ্রেফতার।
নভেম্বরের শেষ দিকে গ্রেফতার করা হয় এক হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় দাস যা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার মূল আসামী হিসেবে।
ভারতের মিডিয়ায় দাবি করা হয় এই ঘটনা ‘গণহত্যার পূর্বাভাস’। হাসিনা ভারত থেকে বিবৃতি দিয়ে সরাসরি ইউনূসকে দায়ী করেন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ‘নীরব হত্যাযজ্ঞে’র জন্য।
ডা. ইউনূসের প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিধ্বনি
এক ভারতীয় সংবাদ সংস্থাকে ডা. ইউনূস বলেন
“সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতার অভিযোগ অতিরঞ্জিত। একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে।”
এই মন্তব্য ভারতে প্রবল ক্ষোভ সৃষ্টি করে। হিন্দুত্ববাদী দলগুলো রাস্তায় নামে, ইউনূস-বিরোধী পোস্টার পড়ে কলকাতা, আসাম, দিল্লি ও বেঙ্গালুরুতে।
আন্তর্জাতিক মহলে শুরু হয় চাপা আলোচনা
- জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ ইস্যু আলোচনায় আসে।
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন চায় পরিস্থিতি স্থিতিশীল হোক, কিন্তু ভারতের প্রভাবে খোলাখুলি কিছু বলা হয় না।
- যুক্তরাষ্ট্র “ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক রোডম্যাপ”-এর উপর গুরুত্ব দিতে বলে।
বাংলাদেশের জনগণের অভিমত: ভারতীয় হস্তক্ষেপ কতটা সহ্যযোগ্য?
বাংলাদেশের সমাজে এই প্রশ্নটা এখন জোরালোভাবে উঠছে “ভারত কি আমাদের প্রতিবেশী, না অভিভাবক?”
“বাংলাদেশি সমাজের সবসময়ই একটা অনুভূতি রয়েছে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খুব বেশি হস্তক্ষেপ করে। আর হাসিনার শাসন সেই হস্তক্ষেপকে বৈধতা দিয়েছে।”
এই অনুভূতি একসময় প্রকাশের সুযোগ পায়নি। কিন্তু এখন, এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা বিস্ফোরণের আকারে প্রকাশ পাচ্ছে।
কূটনীতি, প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ
দুই দেশের সম্পর্ক এখন হিমায়িত এক পাটে বসে আছে।
ভারত তার প্রভাব হারানোর ভয় নিয়ে পা গুটিয়ে নিতে পারছে না, আর বাংলাদেশ তার আত্মনিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়ে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের আবহে পথ খুঁজছে।
এটা শুধুই সরকার পরিবর্তনের ঘটনা নয় এটা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব, পরিচয় ও প্রতিবেশী কূটনীতির নতুন চেহারা।
আগামী দিনে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কতটা ঘন হবে তা নির্ধারণ করবে, বাংলাদেশের মানুষ কাকে রাষ্ট্রের মালিক মনে করে আর ভারত কাকে প্রতিবেশী হিসেবে মানতে শেখে।



