আইন, ও বিচাররাষ্ট্রনীতিসংস্কৃতি

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি ও জনগণের প্রাপ্তি: “বিরিয়ানি নয়, ছিলো পান্তা ভাত”

ইশতিয়াক আহমদ মাসুমঃ

স্বাধীনতা: এক সংগ্রামী স্বপ্নের বাস্তবায়ন?

১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনা এই ভূখণ্ডের জন্য জনগণের প্রত্যাশা ছিল সাম্য, ন্যায়, মানবিক মর্যাদা এবং শোষণমুক্ত এক নতুন সমাজ। কিন্তু ইতিহাসের বাঁকে সেই স্বপ্ন কতটা রূপ পেল এই প্রশ্ন আজও সকলকে আলোড়িত করে। রাষ্ট্রের নেতৃত্ব জনগণকে একরকম ছবি দেখিয়েছিল, বাস্তবে অন্য কিছু উপহার দেয়।

শেখ মুজিবের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ জিতে নেয় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ছয় দফা ছিল নির্বাচনী ইশতেহার স্বায়ত্তশাসন, রাজস্ব ব্যবস্থার আলাদা কাঠামো, মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি। কিন্তু এই ছয় দফায় “জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র” ছিল না। অথচ স্বাধীনতার পর সংবিধানে এই চারটি মূলনীতি জুড়ে দেওয়া হয় জনগণের স্পষ্ট মত ছাড়াই।

ঘোষণাপত্রে কোথায় ছিলো “সাম্য”?

১০ এপ্রিল ১৯৭১-এ প্রণীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার” ছিলো তা বদলে “গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনীরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ” এই শব্দবন্ধ সংযুক্ত করা হয়। এটি ছিল রাজনৈতিক সংকট, গণহত্যা ও স্বাধীনতা যুদ্ধের যুক্তি। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনায় এই শব্দগুলো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যেন তাড়াহুড়ো করে রাষ্ট্রের দর্শন বসিয়ে দেওয়া হয় এক “উপহার প্যাকেট” হিসেবে, যার মধ্যে জনগণের কণ্ঠ অনুপস্থিত।

নতুন রাষ্ট্রে পুরনো শোষণ: প্রশাসন ও অর্থনীতি

স্বাধীনতার পর সরকার জাতীয়করণ, রাষ্ট্রায়ন ও সমাজতন্ত্রের নামে সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণে নেয়। উদ্দেশ্য ছিল সম্পদের ন্যায়বণ্টন, কিন্তু বাস্তবে হলো উল্টো: দপ্তরে দপ্তরে দুর্নীতি, তদবির, দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে চাকরি, আর চাটুকার শ্রেণির উত্থান। গ্রামের কৃষক, শহরের শ্রমিক যারা যুদ্ধ করেছিল, তারা হলো প্রান্তিক। ‘অন্য শাসক’ চলে গেল, ‘নিজের শাসক’ এল কিন্তু শোষণ রইলো।

গণতন্ত্র কই? বাকশাল আসলো

১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠা করে সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়, পাঁচটি ছাড়া সব পত্রিকা নিষিদ্ধ। রাষ্ট্রীয় দল ছাড়া রাজনীতি নিষিদ্ধ। মানুষ মুখ বন্ধ করে চলে, কণ্ঠস্বর হারায়, সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ হয়। সুতরাং গণতন্ত্রের কথা বলে ক্ষমতায় এসে তিনি চালু করেন একদলীয় শাসনব্যবস্থা।

সমাজতন্ত্রের নামে প্রশাসনিক দেউলিয়াত্ব

রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে সমাজতন্ত্র কেবল তত্ত্বেই ছিল। বাস্তবে দেখা গেল চাল চোর, গুদাম সিন্ডিকেট, মজুদদারির রাজত্ব। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার এক নির্মম ব্যর্থতার প্রতীক। হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মরছে, আর সরকার ব্যস্ত আন্তর্জাতিক তহবিল এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন নিয়ে। পত্রিকার শিরোনামে ‘সাম্য’ লেখা ছিল, বাস্তবে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতো রেশন লাইনে।

স্বাধীনতা কি কেবল নেতৃত্বের ছিল?

এই প্রশ্ন তীব্রভাবে উঠে আসে: মুক্তিযুদ্ধে লড়েছিল সাধারণ মানুষ কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, গ্রামবাসী। কিন্তু স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রকাঠামো গঠনে তারা কোথাও নেই। জনগণের অংশগ্রহণের বদলে তৈরি হয় “উপরে নির্দেশ, নিচে আনুগত্য” ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় মানুষের ভূমিকা হয়ে দাঁড়ায় উৎসবের সময় হাততালি দেওয়া ও নির্বাচনের সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়া।

আদর্শ বদলের কৌশল: ছয় দফা থেকে চার মূলনীতি

স্বাধীনতার পূর্বে জনগণ ছয় দফার পক্ষে ভোট দিয়েছিল, কিন্তু স্বাধীনতার পর নেতৃত্ব বলল: “এবার তোমাদের জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র নিতে হবে”। প্রশ্ন হলো এই আদর্শের অনুমতি কে দিল? ছয় দফা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের অর্থনৈতিক ভিত্তি, কিন্তু স্বাধীনতার পর যে আদর্শ চাপিয়ে দেওয়া হলো, তা ছিল নেতৃত্বনির্ভর অভিজাত মতাদর্শিক প্রকল্প

শেখ মুজিব: মুক্তির প্রতীক না রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের রূপ?

শেখ মুজিব ছিলেন নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক নেতা, কিন্তু স্বাধীনতার পর তাঁর ভূমিকা হয়ে ওঠে বিতর্কিত। তিনি হয়ে উঠলেন সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, দলের প্রধান, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রক। তাঁর সমালোচনা করা ছিল নিষেধ, তাঁর নামে সভা করতে হতো, পত্রিকায় নিয়ম করে ছবি ছাপাতে হতো। এমনকি বিচার বিভাগও কার্যত দলীয় নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। রাষ্ট্রের পিতা হয়ে তিনি যেন হয়ে উঠলেন রাষ্ট্রের ‘অধিপতি’।

বিরিয়ানি চাওয়া জনগণ পেল পান্তা ভাত

জনগণ আশা করেছিল স্বাধীনতার পরে পাবে ন্যায়বিচার, মর্যাদা ও শান্তি। কিন্তু পায় এক দুর্বল রাষ্ট্র, যেখানে নেতার কথাই আইন, আর জনগণ নিঃশব্দ অনুসারী। শেখ মুজিব বলেছিলেন, “তোমরা আমাকে স্বাধীনতা দাও, আমি তোমাদের মুক্তি দেবো” কিন্তু জনগণ প্রশ্ন করতে পারে: মুক্তি কোথায়? তা কি শুধু নতুন পতাকা আর নতুন সরকার, নাকি মানুষের ভাত-কাপড়-মর্যাদার বাস্তব প্রতিফলন?

এটাই ইতিহাসের বড় ব্যঙ্গ: স্বাধীনতার নামে যুদ্ধ করে যারা “বিরিয়ানি” আশা করেছিল, তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় “পান্তা ভাত” আর তা-ও কখনো কাটা হাতে, কখনো শোষণের পাতিলে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button