
এম এ মান্নান( অপরাধ বিচিত্রা) :
এই সুদীর্ঘ জীবনে চলার পথে অনেক ঘটনার মুখোমুখী হয়েছি এবং অনেক কিছু স্বচোখে দেখেছি। এর প্রায় সবই বিস্মৃতির আদলে মন থেকে মুছে গিয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু অভাবনীয় ঘটনার স্মৃতি মনের মনিকোঠায় বিশেষভাবে অবস্থান নিয়ে আছে; যা মাঝে মধ্যে জাগরুক হয়ে থাকে। সেই রকম একটি দুঃখজনক ঘটনা প্রথম কাতারের স্মৃতি হিসেবে ৫ আগষ্ট গণঅভ্যুত্থান। সত্যি কথা বলতে কি, ২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট এর ঘটনা আমার কাছে আরব্য রজনীর মতো মনে হয়েছে। কেননা যখন সবাই বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে শোনে যে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পাশের দেশে পালিয়ে গিয়েছেন। তখন অভাবনীয় ঘটনা ঘটে, মুহুর্তে সারা রাজধানীতে লক্ষ লক্ষ লোকের বন্যা বইতে থাকে।
অবশ্য প্রধান জনস্রোত ছিল গণভবনের দিকে। ভাবতে থাকি, এতো লোক কোথা থেকে আসলো? যে ভাবেই বলি না কেন, তখন উৎসব মূখর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। সবাই বলে যে এটি কোটার কারনে হয়েছে। আসলে এটি ঠিক নয়। দীর্ঘ পনের বছর হাসিনার দুঃশাসন ও অপশাসনে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে মারাত্মক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। আর এই ক্ষোভের উপর জলন্ত ম্যাচের কাঠি হিসেবে কোটা ভূমিকা পালন করে। সম্মানিত পাঠক বর্গ আপনারা অন্যভাবে নিবেন না। কেন আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই না? ইসলাম সহ সব ধর্মেই বাড়াবাড়ি গ্রহণযোগ্য নয়। কেন এত অহংকার, কেন বাড়াবাড়ি, কেন ক্ষমতার মোহ, তা আমি বুঝি না।
মানুষের মৌলিক অধিকার গলাটিপে ধরে দেশ শাসন। এমনকি মানুষ হত্যা ও গুম করে, যা ইচ্ছে তাই করা; এ কেমন শাসন আমার বিবেকে আসে না। হয়তো অনেকেই অবহিত আছেন, বৈজ্ঞানিক নিউটনের তৃতীয় সূত্রের কথা। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে প্রত্যেকটি ক্রিয়ার সমমুখী ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে (ঊাবৎু ধপঃরড়হ যধং ধহ ড়ঢ়ঢ়ড়ংরঃব ্ বয়ঁধষ ৎবধপঃরড়হ)। হয়তো শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। তাতে অবাক হবার কিছু নেই। এদিকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্য কারো ক্ষতিসাধন করে, আল্লাহ তা’লা তা দিয়েই তার ক্ষতি সাধন করে থাকেন। কেন আমরা ভুলে যাই, সেই সব মহাবাণী।
যাহোক, আমার একটি বড় দুঃখ যে, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী অপশাসন ও অপকর্ম করে জীবন ভয়ে ভীত হয়ে অন্য দেশে পালিয়ে যান। তাহলে কি তাঁর সম্মান থাকে; নাকি দেশের সম্মান থাকে; নাকি আমাদের সম্মান থাকে? আমাদের কি বিশ্ববাসীর কাছে তাঁর কারনে মাথা হেট হয়ে যাই না? (আ) বস্তুত দুনিয়া কাঁপানো জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের ৩৬ দিন। গোটা দুনিয়ার চোখে ছিল বাংলাদেশের দিকে। দীর্ঘ দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের জনগণের ঘাড়ে চেপে বসা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলনের সুনামিতে কেঁপে উঠেছিল ধান-শালিকের বাংলাদেশ।
সারা বিশ্ব দেখেছে, একদল নিরস্ত্র মানুষ কীভাবে সাহসে বুক বেঁধে হাসিনার অনুগত নিরাপত্তা বাহিনী ও পেটুয়া ক্যাডার বাহিনীর বুলেট-বোমা উপেক্ষা করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। আশ্চার্যর বিষয় হলো যে, এই আন্দোলন শুরু করেছিল একদল তরুণ-কিশোর শিক্ষার্থী। তাদের নেতৃত্বেই পরে দলে দলে রাজপথে নেমেছে নারী, পুরুষ, নবীন, প্রবীণ সর্বস্তরের মানুষ। শেখ হাসিনার দেড় দশকের অপশাসন বিশ্লেষণ করলে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তিনি ছিলেন চরম ফ্যাসিস্ট আয়রন লেডি। তিনি হিটলারকেও হার মানিয়েছেন। কেননা হিটলার তো ইহুদী ব্যাতিরেকে নিজের মানুষকে হত্যা করেনি। এদিকে হাসিনার দুশাসনের বিরুদ্ধে মুখ খুলে অনেক সাহসী। মানুষ হয়তো গুম বা আয়নাঘর কিম্বা বিনাদোষে কারাগারে।
তাছাড়া তিন তিন বারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন। এমন এক দানবীয় ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে রাজপথে আগুনঝরা শ্লোগানে রাস্তায় নেমেছিল তরুণ-কিশোর শিক্ষার্থী এবং তাদের সাথে যুক্ত হয়েছিল সাধারণ জনসাধারণ। মোটের উপর ছাত্র-জনতা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সংগ্রাম করে ছিনিয়ে এনেছে এই রক্তমাখা বিজয়। পৃথিবীর ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে প্রণীত হয়েছে এই গৌরবময় মহাকাব্য। সত্যি কথা বলতে কি, এ ঘটনার মাঝে লুকিয়ে আছে মানবজাতির জন্য এক শিক্ষণীয় দর্শন। এদিকে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে প্রায় ২ হাজার মানুষ শাহাদাত বরণ করেছেন।
এ তালিকায় আছে শিশু ১৩৫ ও ১১ জন নারী। আর হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)-এর প্রতিবেদন সূত্রে প্রকাশ, শাহাদাত বরণকারীদের ৭২ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের মধ্যে। এ বিপ্লবে ৫০০ জন অন্ধ এবং প্রায় ২০ হাজার জন আহত হয়েছেন । তাদের অধিকাংশই কিশোর ও তরুণ। জুলাই-আগস্ট ২০২৪ প্রেক্ষাপট’ গবেষণা প্রতিবেদনে সূত্রে প্রকাশ, জুলাই ও আগস্টে ছাত্র- জনতার আন্দোলন চলাকালে প্রায় ১৬৮ জন পথ শিশু নিহত হয়েছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, গুলি বা ছররা গুলির কারণে গুরুতর চোখের আঘাতের জন্য ৫০৬ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয় এর মধ্যে অন্তত ৬০ জন শিশু ছিল। তাদের মধ্যে একজন ৯ বছর বয়সি পথশিশু চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। এতদ্ব্যতীত এই ফ্যাসিস্ট হাসিনার প্রতিবেশি দেশের কাছে নতজানু কার্যক্রমসহ লক্ষ কোটি টাকা পাচার ও অন্যান্য অপকর্মের কথা বাদই দিলাম।
(ই) কালের পরিক্রমায় দেখতে দেখতে ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানের এক বছর হয়ে গেল। ২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী শাসনের পতনের পর দেশের মানুষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য ৫৬ পারসেন্ট কোটা, আর ৪৪ পারসেন্ট মেধাবীদের জন্য বরাদ্দ ছিল বাংলাদেশে। ২০১৮ সালে ছাত্ররা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। আন্দোলনের পর সরকার ছাত্রদের দাবির মুখে সংস্কার না করে কোটা বাতিল করে দিয়ে পরিপত্র জারি করেছিল। ওই পরিপত্রের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নবম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সকল কোটা বাতিল করা হয়েছিল।
এটা কিন্তু ছাত্ররা চায়নি। তারা চেয়েছিল সংস্কার। বাতিল করে দিয়ে সংকটের বীজ রেখে দেওয়া হয়েছিল। আর সেটারই প্রকাশ ঘটে ২০২৪ সালের ৫ জুন কোর্টের আদেশের মধ্য দিয়ে। হয়তো সবারই জানা কোটা সংস্কার আন্দোলন একসময়ে সরকার পতনের এক দফায় গড়ায়। আর অবস্থার প্রেক্ষাপটে তা হয়ে ওঠে রক্তাক্ত আন্দোলন। সত্যি কথা বলতে কি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বা জুলাই বিপ্লব কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০২৪ এবং অসহযোগ আন্দোলন ২০২৪-এর সমন্বিত আন্দোলন। ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন করে মোড় নেয়। এই আন্দোলনে তৎকালীন শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার দমন নিপীড়ন শুরু করলে এটি অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়।
আর এই গণঅভ্যুত্থানের কারণে স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পলায়ন করতে বাধ্য হলে বাংলাদেশ সাংবিধানিক সংকটে পড়ে এবং এর তিন দিন পরে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। প্রকাশ থাকে যে, ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ কোটাব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে। রায় প্রকাশের পরপরই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। তারা বলতে গেলে ঝিমিয়ে পড়া অবস্থা থেকে আবার জেগে ওঠে। জুলাই মাসে আন্দোলন আরও তীব্র রূপ নেয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’-সহ অবরোধ কর্মসূচি চালায়।
এই সময়ে আন্দোলন দমাতে পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের ফলে সংঘর্ষ ঘটে এবং রংপুরে আবু সাঈদ নামে একটি শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই ঘটনাটি আন্দোলনকে আরও জোরালো করে এবং দেশজুড়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। আরেক শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। সে উত্তরায় আন্দোলনরতদের পানি পান করাতো। “পানি লাগবে পানি” বলে বোতল নিয়ে হাঁটতো। সেও আন্দোলনের অন্যতম আইকনে পরিণত হয়েছে। অবশ্য তাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। (ঈ) ঘটনা প্রবাহের ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, ২১ জুলাই আপিল বিভাগ কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে। একই সাথে সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয় হলেও সংবিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালত সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ মেধাভিত্তিক নিযোগ দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
এইদিন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কারফিউর মধ্যেও সর্বোচ্চ আদালতের কার্যক্রম বসেছিল। কিন্তু সরকার ও আদালত এত কিছু করলেও ছাত্র-জনতা তাদের কথায় কান দেয়নি। কেননা এর মধ্যে সে সময় পাড় হয়ে গিয়েছে। তারা আন্দোলন অব্যাহত রাখে। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনরতদের গুলি করে হত্যা করে পুলিশসহ সরকারের পেটোয়া বাহিনী। এর পরিনতিতে আসে এক দফার আন্দোলন। তাতে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে যোগ দেন সর্বস্তরের মানুষ। ৪ আগস্ট “মার্চ টু ‘ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এ দিন প্রায় ১০০ জন নিহত হয়। অবশেষে ৫ আগস্ট বা ৩৬ জুলাই ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি চলাকালে কারফিউ ও সকল বাধা-বিঘ্ন উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা রাজপথ দখলে রাখে। ছাত্ররা জুলাই আন্দোলনকে স্মরণীয় রাখতে ৫ আগস্টকে ৩৬ জুলাই অভিহিত করে। কেননা এই দিন দুপুরে আসে বিজয়ের লগ্ন। স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এভাবে বিজয়গাথা রচিত হয় রক্তের পথ বেয়ে।
(উ) দিনের উপর দিন ভর করে গণঅভ্যুত্থানের এক বছর তথা ৩৬৫ তিন পার হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে ইতি ও নেতিবাচক অনেক কিছু পরিলক্ষিত হয়েছে। বর্তমান মধ্যবর্তী সরকার আশা ব্যঞ্জক সহযোগিতা পাচ্ছেন না। কথায় কথায় মিছিল মিটিং চলছে। শুধু তাই নয়, দেশি-বিদেশি চক্রান্ত চলছে বলে প্রতীয়মান হয়। সে যাই হোক না কেন, অকালে মৃত্যুবরণকারী শহীদদের রক্তের উপর যেন আমরা বিশ্বাস ঘাতকতা না করি। পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে ভবিষ্যতে যাতে আর প্রজন্মের পর প্রজন্মে কোন স্বৈরাচার সৃষ্টি না হয় এবং ছাত্র-জনতার যেন এ ভাবে রক্ত না দিতে হয়, সে ব্যাপারে যেন সদা চোখ কান খোলা রাখি। নতুবা আমরা দায়ভার এড়াতে পারবো না।
মোঃ আব্দুল বাকি চৌধুরী,,,,,,,,,,,



