ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবর্তন: শেখ মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে ইসলামকে সংকুচিত করার অভিযোগ

ভূমিকা:
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গৃহীত অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। এই নীতি প্রবর্তনের পর থেকে এর প্রভাব ও কার্যকারিতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা ও বিতর্ক চলমান রয়েছে। সমালোচকদের একাংশ দাবি করেন, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের ইসলামী পরিচয় এবং সংস্কৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। তাদের মতে, শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ ছিল ইসলামকে সংকুচিত করার প্রয়াস।
রাজনৈতিক ও আদর্শিক পরিবর্তন:
অভিযোগ করা হয়, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এক ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন যে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বা দলের কোনো স্থান থাকবে না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়।
সমালোচকরা প্রায়শই কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকার ২৯ নভেম্বর, ১৯৭২ সংখ্যায় সৈয়দ মুজতবা আলী ও সন্তোষ কুমার ঘোষের সঙ্গে শেখ মুজিবের একটি আলাপচারিতার উদ্ধৃতি দেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশ ও সেক্যুলার বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষাকারী হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ। আমি এই ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের চারা বাংলাদেশের মাটিতে পুঁতে দিলাম। যদি কেউ এই চারা উৎপাটন করে, তাহলে বাঙালি জাতির স্বাধীন অস্তিত্বই সে বিপন্ন করবে।”
এছাড়াও, পাকিস্তান আমলে যেখানে আওয়ামী লীগের সভা কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু এবং খোদা হাফেজ বলে শেষ হতো, সেখানে স্বাধীনতার পর দলীয় সঙ্গীত দিয়ে সভা শুরু এবং ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে শেষ করার রীতি চালু হয় বলে দাবি করা হয়।
সাংবিধানিক ও প্রতীকী পরিবর্তন:
ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির আওতায় ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। পাশাপাশি, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রাম থেকেও ইসলামিক প্রতীক বা আয়াত মুছে ফেলা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের মনোগ্রাম: এখান থেকে “ইক্বরা বিসমি রাব্বিকাল্লাযি খালাক” (পড়ুন আপনার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন) আয়াতটি বাদ দেওয়া হয়।
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম: “রাব্বি জিদনী ইলমা” (হে প্রভু, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন) আয়াতটি সরানো হয়।
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম: এখান থেকেও “ইক্বরা বিসমি রাব্বিকাল্লাযি খালাক” আয়াতটি বাদ দেওয়া হয়।
শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন:
১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশনের নীতিমালার মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে ইসলাম শিক্ষা বাদ দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়। একই সময়ে বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে ‘মুসলিম’ বা ‘ইসলাম’ শব্দ সরিয়ে ফেলা হয়:
- সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নাম পরিবর্তন করে ‘সলিমুল্লাহ হল’ করা হয়।
- ফজলুল হক মুসলিম হলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।
- জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’ রাখা হয়।
- নজরুল ইসলাম কলেজের নাম থেকে ‘ইসলাম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘নজরুল কলেজ’ করা হয়।
সমালোচকরা প্রায়শই ভারতের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানে নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দটি আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
প্রশাসনিক ও সামাজিক পরিবর্তন:
অভিযোগ রয়েছে, শেখ মুজিব সরকারের আমলে ভারতের অনুকরণে শুক্রবারের সাপ্তাহিক ছুটি পরিবর্তন করে রবিবার করা হয়, যা মুসলমানদের জুমার নামাজ আদায়ে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল।
এছাড়াও, ১৯৭৩ সালে গঠিত রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থী মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগ তোলা হয়।
সাংস্কৃতিক প্রভাব:
সমালোচকরা আরও দাবি করেন যে, যুদ্ধপরবর্তী সময়ে নির্মিত বিভিন্ন নাটক-সিনেমায় খলনায়ক বা রাজাকার চরিত্রে দাড়ি-টুপিযুক্ত ব্যক্তিকে দেখিয়ে ইসলাম ও মুসলিমদের সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল, যদিও যুদ্ধকালীন বাস্তবতার সঙ্গে এর মিল ছিল না বলে তারা মনে করেন।
উপসংহার:
উপরিউক্ত অভিযোগগুলো প্রায়শই শেখ মুজিবুর রহমানের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সমালোচনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। সমালোচকদের মতে, এই পদক্ষেপগুলো ছিল বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি ও সংস্কৃতির পরিপন্থী। তবে, এর বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতার সমর্থকরা মনে করেন, একটি নতুন যুদ্ধবিধ্বস্ত ও বহুত্ববাদী রাষ্ট্রে সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য এই পদক্ষেপগুলো অপরিহার্য ছিল।



