একটি দেশের জাতীয় সংসদ সঠিকভাবে দেশ পরিচালনার চালিকা শক্তি। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসহ সব কিছুরই নীতিমালা নির্ধারণ করা হয় সংসদে আলোচনার মাধ্যমে। আর বিশেষ করে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও এই সংদের ওপরই। এখানে বসে সংসদ সদস্যরা যে আইন তৈরি করবেন দেশের জনগণ তা মানতে বাধ্য। তবে, বর্তমান সংসদের তৈরি অনেক আইন নিয়েই জনগণের মধ্যে প্রশ্ন আছে। সংখ্যাগরিষ্টতার বলে সরকার এসব আইন পাস করলেও জনগণ তা এখনো মেনে নিতে পারছে না।
বর্তমান একদলীয় সংসদে যারা ভোটে-বিনাভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন তাদের নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। তদের অনেকই সামাজিক অপরাধসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। দেশে মাদক নিষিদ্ধ হলেও কক্সবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। এই সংসদ সদস্য মাদক সম্রাট হিসেবে সারাদেশে পরিচিত। খুনের মামলার একাধিক আসামি আছে বর্তমান সংসদের এমপি। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলেও সরকার তাদেরকে ধরে রাখছে। ফেনীর নিজাম হাজারী ও টাঙ্গাইলের এমপি রানা খুনের মামলার আসামি। এছাড়া প্রায় সব সংসদ সদস্যই দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত।
সর্বশেষ সুপ্রিমকোর্টও সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে বর্তমান সংসদের অনেক সদস্য অপরাধে জড়িত বলে উল্লেখ করেছেন।
হাইকোর্টের রায়ের একটি অংশ তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা লিখেছেন, আমাদের অভিজ্ঞতা এটা দেখাচ্ছে যে, সংসদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড রয়েছে। তারা দেওয়ানি মামলাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর কারণে সংসদ সদস্যরা বিচারকদের কার্যত বসে (কর্তৃত্ব অর্থে) পরিণত হয়েছেন, যা উচ্চ আদালতের বিচারকদের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে হুমকি সৃষ্টি করেছে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী সংসদের ৭০ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং মুরাদ রেজা (অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল) এ তথ্যের বিষয়ে আপত্তি করেননি। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখতে পাই, আইন প্রণয়নসংক্রান্ত সংসদীয় বিতর্কে তারা কম আগ্রহী। এর পরিণাম হল, আজকের দিনে সংসদে পাস করা বেশিরভাগ আইন ‘ত্রুটিযুক্ত’। অসম্পূর্ণ এবং ‘নীচুমানের’ আইন প্রণয়নে তাদের দায়িত্ব উত্তমরূপে পালনের চেয়ে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের অপসারণের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে তারা বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছেন। বিচারকদের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের বিচার করা আইনপ্রণেতাদের কাজ নয়।
আদালতের এই পর্যবেক্ষণের পর বর্তমান সংসদের এমপিদের নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের ডাল-পালা এখন আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমান সংসদের এমপিদের শিক্ষা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে যে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছিল তাকে যথার্থ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের মতে, একটি রাষ্ট্রের সামগ্রীক উন্নয়নের লক্ষ্যে যেসব আইন দরকার তা তৈরি করার মতো যোগ্যতা বর্তমান সংসদের এমপিদের নেই। কারণ, তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। বিরোধীদলকে দমনের জন্য যেসব আইন দরকার তারা শুধু সেসব আইন তৈরি করেছে। আদালতের রায়েও এটা প্রমাণিত হয়েছে।
কেউ কেউ বলছেন, অপরাধীরাই এখন দেশের আইন প্রণেতা। অপরাধীরা যে দেশে আইন তৈরি করে সে দেশে কখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না। কারণ, অপরাধীরা সব সময়ই নিজেদের পক্ষে আইন তৈরি করে। তারা কখনো নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের কথা ভাবে না।