পুরান ঢাকার মানুষ ২০১০ সালের ৩ জুন নবাব কাটরার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা আজও ভোলেনি। সেই অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন প্রাণ হারান। আর অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল গুদামে রক্ষিত রাসায়নিক পদার্থের কারণে। নিমতলীর সেই ঘটনা দেশ-বিদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর হয়ে দাঁড়ায়। ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকায় রাসায়নিক কারখানা স্থাপনের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তখন জোর দাবি ওঠে, পুরান ঢাকা থেকে এসব রাসায়নিক পদার্থের গুদাম সরানোর। দুর্ঘটনার পরপরই সরকারিভাবে বিভিন্ন কমিটি গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি পুরান ঢাকার সব রাসায়নিক কারখানা, গুদাম ও দোকানের জন্য অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত নতুন কোনো এলাকায় গড়ে তোলার সুপারিশ করে। কিন্তু এত বছর হয়ে গেলও তৎকালীন কমিটির সুপারিশ আজও পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। নিমতলীর সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ছেলে হারানো বাবা মামুন জানান, আমি সেই অগ্নিকাণ্ডের কথা আর মনে করতে চাই না। সে আগুন আমার সাত বছরের ছেলে বৈশাখকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।
নিমতলীর বাসিন্দা সাদেক জানান, দোজখের আগুন কাকে বলে সে রাতে আমি দেখেছি। সে রাতের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে আমার এক ছেলে আর এক মেয়েকে হারিয়েছি। আগুনে দগ্ধ হয়ে আমার ছেলেমেয়েকে কাতরাতে দেখেছি। যদি সময়মতো আমার ছেলেমেয়েকে হাসপাতালে নিতে পারতাম তাহলে হয়তো আমার ছেলেমেয়ে বাঁচত। কিন্তু বাঁচাতে পারিনি, কারণ অ্যাম্বুলেন্স এ চিপা গলিতে ঢুকতে পারেনি। এভাবে অনেকের মৃত্যু হয়েছে।
নিমতলীর বাসিন্দা ইসমাঈল জানান, আগুনের সূত্রপাত কিভাবে হয়েছে সেটা আমি দেখেছি। সেই রাতে কেমিক্যাল গুদামের সামনে বিয়ের রান্নাবান্না হচ্ছিল। সেই আগুনের তাপে কেমিক্যালের গুদামে আগুন ধরে যায়। তারপর গুদামের আগুনে বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণ হয়ে চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
আলোচিত নিমতলীর দুর্ঘটনার পর গত কয়েক বছরে আরও একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল চকবাজারে ছোট কাটারায় পারফিউমের গুদামে আগুনে নিহত হন এক ব্যক্তি। ২০১৫ সালের ১৯ ও ২৩ নভেম্বর সোয়ারীঘাট ও রহমতগঞ্জের পলিথিন কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পোস্তায় আগুনে পুড়ে ২ বছরের এক শিশু মারা যায়। ১৬ মে আলুবাজারের জুতা কারখানায় আগুনে ৩ জন দগ্ধ হন। ২২ জুন লালবাগের নবাবগঞ্জে রাসায়নিক গুদামে আগুনে ২ জন নিহত হন। এছাড়া গত বছর ইসলামবাগ, লালবাগ ও আশপাশের এলাকায় রাসায়নিক, পলিথিন ও প্লাস্টিক কারখানায় অত্যন্ত ২৫টির মতো আগুনের ঘটনা ঘটে। এ বছরের ২৭ জানুয়ারি বংশালে জুতার কারখানায় আগুনে ২ জন নিহতসহ আরও ২ জন দগ্ধ হন।
ঢাকা মহানগরীতে হাজারের বেশি রাসায়নিক গুদাম ও প্লাস্টিক কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮৫০টি পুরান ঢাকায়। পুরান ঢাকার লালবাগ, ইসলামবাগ, চাঁদনীঘাট, মিটফোর্ড, আরমানীটোলা, চকবাজারের আশপাশে অবস্থিত বেশিরভাগ বহুতল ভবনের নিচ তলায় রাসায়নিক গুদাম এবং প্লাস্টিক ও পলিথিন কারখানাসহ মহল্লার অলি-গলিতে গড়ে উঠেছে রাসায়নিক দোকান। ভুক্তভোগীরা জানান, রাসায়নিক পদার্থের গ্যাসে বাতাস দূষিত হওয়ায় এখানে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। শিগগিরই যদি এসব কারখানা, গুদাম, দোকানপাট না সরানো হয় তাহলে এ এলাকায় বসবাস করে বেঁচে থাকা দায় হয়ে দাঁড়াবে। এসব গুদাম কারখানা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছে পরিবেশ অধিদফতর, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, বিস্ফোরক অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিস ও জেলা প্রশাসক। কিন্তু এসব সংস্থা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে তা বর্তমান দৃশ্য দেখলে বোঝা যায়।
পোস্তায় অবস্থিত, ‘বিসমিল্লাহ প্লাস্টিক’ এর মালিক শাজাহান জানান, প্লাস্টিক শিল্প দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার ছাড়া এখন আর কেউ চলতে পারে না। বাংলাদেশে কেমিক্যাল ও পারফিউমারি অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি আবদুল জলিল জানান, এমন কোনো শিল্প কারখানা নেই যেখানে কেমিক্যালের ব্যবহার হয় না। সব শিল্প-কারখানায় কেমিক্যাল অপরিহার্য। কেমিক্যাল ছাড়া কোনো শিল্প-কারখানা চলতে পারে না। তবে সরকার ২১টি কেমিক্যালের গুদাম পুরান ঢাকা থেকে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সোবহান জানান, পুরান ঢাকা এখন অতিরিক্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। এসব এলাকায় একই ভবনে বাসা বাড়ি, রাসায়নিক কারখানা, গুদাম, দোকান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।