আ’লীগের দুর্গে হানা দিতে চায় দুর্বল বিএনপি

0
441

জমে উঠছে বাউফল উপজেলা নিয়ে গঠিত পটুয়খালী-২ আসনের রাজনৈতিক অঙ্গন। আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনে ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনসহ মাত্র দু’বার জয়লাভ করেছে বিএনপি। বাকি যে কবার নির্বাচন হয়েছে তাতে আওয়ামী লীগ নয়তো স্বতন্ত্র পরিচয়ে কোনো নেতা জয়ী হয়েছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জন্মস্থান হওয়ায় চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে খেলার মাঠ- সবখানেই আলোচনা সম্ভাব্য প্রার্থী নিয়ে। জেলার বৃহত্তম উপজেলা বাউফলের ১টি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনে ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৪৪ হাজার ২১৩। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ২১ হাজার ৬৬৪। আগামী নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি শহিদুল আলম তালুকদার, বাউফল উপজেলা বিএনপির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার ফারুক আহম্মেদ তালুকদার, বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দফতর সম্পাদক ও ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মো. মুনীর হোসেন, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মো. মুনিরুল ইসলাম এবং জিয়া তথ্য ও গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. আনিসুর রহমান।

Advertisement

এ আসনে আওয়ামী লীগের ৬ বারের এমপি ও বর্তমান সংসদ সদস্য চিফ হুইপ আসম ফিরোজ ছাড়াও যাদের নাম আলোচনায় আসছে তারা হচ্ছেন- বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মো. রেজা খন্দকার, প্রিমিয়ার লিজিং সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান এসএম ফিরোজ আলম, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক জোবায়দুল হক রাসেল এবং বাউফল পৌরসভার বর্তমান মেয়র জিয়াউল হক জুয়েল। এছাড়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মালেকের নামও জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে। আবদুল মালেকের অবসরে যাওয়ার কথা আগামী বছরের শেষ নাগাদ। ফলে একাদশ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। তবে আগেভাগে অবসরে গেলে একটা সম্ভাবনা থাকবে। সব কিছুই নির্ভর করবে প্রধানমন্ত্রীর সিগনালের ওপর। এলাকায় আবদুল মালেকের একটা পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি রয়েছে। জানতে চাইলে আবদুল মালেক বলেন, ‘জনসাধারণের বাকস্বাধীনতা রয়েছে। তারা তাদের পছন্দের কথা বলতেই পারে। কিন্তু সরকারের একজন দায়িত্বশীল কর্মী হিসেবে এ ব্যাপারে মন্তব্য করার সুযোগ আমার নেই।’ প্রধান দুই দলের বাইরে যে কোনো ফর্মে এ আসনে নির্বাচন করতে চাচ্ছেন নিবন্ধনহীন দল জামায়াতের ঢাকা দক্ষিণের সম্পাদক ড. শফিকুল ইসলাম।
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে ওয়ান-ইলেভেনের সংস্কারবাদী নেতা সাবেক এমপি শহিদুল আলম তালুকদার সক্রিয় রয়েছেন। দলের মূল ধারার বাধার মুখে দীর্ঘ সময় দলীয় কার্যালয়ে যেতে না পারা এ নেতাই এ আসনে বিএনপিকে জয় উপহার দিয়েছিলেন। সরকারি সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের মামলা চলছে তার বিরুদ্ধে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় নিজ হাতে সাংবাদিক পিটিয়ে আলোচনায় আসা শহিদুল আলম রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রের সঙ্গেও লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। কথা হয় শহিদুল আলমের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘জনগণের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের জন্যই রাজনীতি করি। জনগণই আমার শক্তি এবং ভরসার স্থান। দল যদি আমাকে সুযোগ দেয় আশা করি আগামী নির্বাচনে আসনটি উপহার দিতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘এখানে আমিই একমাত্র আওয়ামী লীগের দুর্গে হানা দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছি। কাজ করতে গেলে কিছু ভুল-ত্রুটি হতেই পারে। আমার বিরুদ্ধে যেসব কথা বলা হচ্ছে সবটা সত্য না।’
বিএনপির আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী উপজেলা বিএনপির সভাপতি শিল্পপতি ইঞ্জিনিয়ার একেএম ফারুক আহমেদ তালুকদার। দলের সভাপতি হলেও মাসের পর মাস এলাকায় আসেন না তিনি। দলের ‘প্রভাবশালী’ এ নেতার বিরুদ্ধে প্রশাসনের সঙ্গে ম্যানেজ করে চলার অভিযোগ রয়েছে। আন্দোলন-সংগ্রামে তো দূরের কথা ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজেই তাকে মাঠে পাওয়া যায় না। নেতাকর্মীরা যখন ঘরছাড়া তখন হেলিকপ্টারে উড়ে এসে পুলিশের নিরাপত্তায় নিজেকে সভাপতি বানিয়ে উপজেলা বিএনপির কমিটি করেন তিনি। এ নিয়ে তৃণমূলে নানা কথা চালু আছে। এছাড়া ২০টি গরু জবাই দিয়ে ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্ট পালন, শোক দিবসে বিএনপিদলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং বিএনপিতে আসার আগে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে ব্যাপক দৌড়ঝাঁপের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, তিনি কখনোই কারও ফোন ধরেন না।
এর বাইরে কিছুটা ভিন্ন ধারার রাজনীতির চর্চা শুরু করছেন সাবেক ছাত্র নেতা ঢাকসুর সাবেক মিলনায়তন সম্পাদক বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দফতর সম্পাদক মো. মুনীর হোসেন। সম্প্রতি তিনি বাউফলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে গণসংযোগ করার পাশাপাশি বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজ করছেন। নির্বাচন নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আমি বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে কাজ করছি। দলীয় মনোনয়ন পেলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব যাতে এ আসনটি আওয়ামী লীগের হাত থেকে পুনুরুদ্ধার করা যায়।’ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে যারা দৌড়ঝাঁপ করছেন তাদের মধ্যে বর্তমান এমপি চিফ হুইপ আসম ফিরোজ এগিয়ে। তিনিই এ আসনে একবার স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে থাকলেও বেশ কিছু বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তিনি। ১৯৭৫’র ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরদিন সকালে বরিশাল শহরে আনন্দ মিছিলের নেতৃত্ব দেয়া, প্রকাশ্যে জাতির জনকের ছবি পদদলিত করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যদিও এসব অভিযোগ ষড়যন্ত্র বলে তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন। এছাড়া সরকারের বকেয়া বিল পরিশোধ না করার কারণে আদালতে হাজির হতে বাধ্য হওয়া, সরকারি ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা, ঢাকায় রাজউক ভবনের কক্ষ অবৈধভাবে দখল করে রাখা, বিভিন্ন সময়ে ‘ক্রেস্ট নয় ক্যাশ’ জাতীয় বিতর্কিত কথা বলে সংবাদপত্রের শিরোনাম হওয়া, জুতো পায়ে শহীদ বেদীতে উঠার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সংসদ সদস্যের পাশাপাশি দীর্ঘ দিন ধরে যে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে আছেন। জানতে চাইলে বাউফল পৌরসভার মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা জিয়াউল হক জুয়েল বলেন, ‘রাজনীতিতে উনি যেমন কাউকে ছাড় দিতে চান না তেমনি এখানে উনি ছাড়া আর কেউ নেতা হোক তাও তিনি চান না।’ জানতে চাইলে আসম ফিরোজ বলেন, ‘ছাত্র জীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছি। সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত দেবেন সে অনুযায়ী অতীতেও কাজ করেছি ভবিষ্যতেও করব। রাজনৈতিক কারণে একটি মহল কিছু অভিযোগ সব সময়েই আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে রাখে। পটুয়াখালী জুট মিলের আমি একজন ডিরেক্টর মাত্র। আর জুট মিলের নামে রাজউকে যে কক্ষ বরাদ্দ নেয়া আছে তার ভাড়া দেয়া হয় না কথাটিও সত্য নয়। যেহেতু জুট মিলটি এখন আর লাভজনক প্রতিষ্ঠানে নেই তাই অনেক জীর্ণতার মধ্য দিয়ে চলছে। এজন্য ওই কক্ষের ভাড়া দিতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষের। ব্যাংকে যে ঋণ খেলাপি হয়েছিল তার কিস্তি পরিশোধের মাধ্যমে পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এর বাইরে আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তার কোনোটিই সত্য নয়।’ আসম ফিরোজের পরই মনোনয়ন দৌড়ে আছেন বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুল হক রেজা খন্দকার। স্থানীয়ভাবে ক্লিন রাজনীতিক হিসেবে তার পরিচিতি থাকলেও জনসংযোগ এবং জনসম্পৃক্ততার কারণে এখন পর্যন্ত তৃণমূলে তেমন সাড়া ফেলতে পারেননি এ নেতা। প্রিমিয়ার লিজিংয়ের চেয়ারম্যান এসএম ফিরোজ আলমেরও একই অবস্থা। এই দুই নেতা ছাড়াও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক উপ-সম্পাদক জোবায়দুল হক রাসেলেরও মনোনয়নকেন্দ্রিক তৎপড়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে জনসংযোগের কাজ করছেন এ আওয়ামী লীগ নেতা। এছাড়া আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাউফল পৌরসভার মেয়র জিয়াউল হক জুয়েল। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজস্ব একটি বলয় সৃষ্টির জন্য কাজ করছেন এ নেতা। মাত্র ২২ দিনের নির্বাচনী প্রচারণায় বাউফল পৌরসভার মেয়র হন তিনি।

Advertisement

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here