আ’লীগের শক্ত ঘাঁটি : ভাগ বসাতে প্রস্তুত বিএনপি

0
988

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গলাচিপা ও দশমিনা উপজেলা নিয়ে পটুয়াখালী-৩ আসনের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী আলোচনা শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের হাতে রয়েছে ৪ বারের বিজয়ী চানক্য নির্বাচনী অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন। বিএনপির হাতেও রয়েছে ক্লিন ইমেজের প্রার্থী হাসান মামুন। শেষ পর্যন্ত এ দু’জন যদি মনোনয়ন পান তাহলে জমজমাট হয়ে উঠতে পারে এ আসনের নির্বাচনী লড়াই। গলাচিপা উপজেলায় ১২টি ইউনিয়ন, এক পৌরসভা ও দশমিনার ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে এ আসন। গত নির্বাচনী পর্যালোচনায় দেখা যায়, বরিশাল বিভাগের এ আসনটি আওয়ামী লীগের দুর্গ। সামরিক শাসন ছাড়া সবকটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছে। এ আসনে জামায়াতের ভোট রয়েছে ৮ থেকে ১০ হাজার। চর ইসলামী আন্দোলনের প্রভাব রয়েছে কয়েকটি ইউনিয়নে। উপজেলা ও ইউপি নির্বাচনে তার টের পাওয়া যায়। বড় দুই দলের প্রার্থীর জয়-পরাজয়ের নিয়ামক শক্তি হিসেবেও দাঁড়াতে পারে দলটি। বিগত দিনে হুট করে মনোনয়ন নিয়ে এ দলের কোনো প্রার্থীর তৎপর হয়ে ওঠার নজির রয়েছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে। আ’লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন বর্তমান এমপি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আ’লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফোরকান মিয়া, কেন্দ্রীয় যুবলীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক কামরান শাহীদ মহাব্বাত প্রিন্স, স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সম্পাদক আরিফুর রহমান টিটু, দশমিনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল আজীজ মিয়া, দশমিনা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শাখাওয়াত হোসেন, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফজলুল হক এবং এসএম শাহজাদা। অপরদিকে বিএনপির তিনজনের নাম আলোচনায় রয়েছে। এরা হলেন- বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক ছাত্রদল নেতা হাসান মামুন, গলাচিপা উপজেলা বিএনপির সভাপতি শিল্পপতি গোলাম মোস্তফা ও জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি শাজাহান খান। এরা তিনজনই মাঠে সক্রিয়। কথা হয় দশমিনা উপজেলা বিএনপির নেতা ইয়াসিন আলী খানের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে জানান, ‘হাসান মামুন ভদ্র, বিনয়ী ও মার্জিত স্বভাবের। এলাকায় তার রয়েছে ক্লিন ইমেজ। স্থানীয় বিএনপির গ্রুপিংয়ে তিনি নিজেকে জড়াননি। গত জোট সরকারের সময়ে হাসান মামুন এলাকার বেশ কিছু শিক্ষিত যুবকের কর্মসংস্থানে অবদান রেখেছেন। এর প্রভাব একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়বে বলে দলের অনেক নেতা আশা করছেন।’

Advertisement

মনোনয়ন ও দলের পদ-পদবিকে কেন্দ্র করে উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি শাহজাহান খান ও বর্তমান সভাপতি গোলাম মোস্তফার বিরোধের সূত্রপাত ’৯৬ সাল থেকে। ওই সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে শাহজাহান খান জয়লাভ করলেও একই বছর জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর হোসাইনের কাছে হেরে যান। তাছাড়া গোলাম মোস্তফার ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা শাহ আলম। এ নিয়েও নানা কথা চালু আছে। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময় দলীয় প্রার্থী শাহজাহান খানের পক্ষে কাজ করেননি গোলাম মোস্তফা। এমনকি এলাকায়ও আসেননি তিনি। শাহজাহান খান ও গোলাম মোস্তফার বিরোধ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। সুবিধাবাদী চরিত্র হিসেবে দুর্নাম রয়েছে গোলাম মোস্তফা এবং তার পরিবারের। তার ভাই শাহ আলম ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য ব্যাপক লবিং করেও শেষ পর্যন্ত পাননি। পরের দফায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও মনোনয়নের জন্য মাঠে নেমেছিলেন তিনি। গোলাম মোস্তফার বড় ভাই আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে চরবিশ্বাস ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। গেল বছর পুনরায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে না পেয়ে গোলাম মোস্তফার সহায়তায় মনোনয়ন নেন বিএনপি থেকে। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা হয়েও ধানের শীষ প্রতীকে অংশ নেন ইউপি নির্বাচনে। নির্বাচনে গোলাম মোস্তফা এবং শাহ আলম একযোগে তার ভাইয়ের জন্য মাঠ চষে বেড়ান। গলাচিপা উপজেলা বিএনপির একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, ‘আসলে রাজনৈতিক আদর্শ বলতে যা বোঝায় তার ছিটেফোঁটাও নেই গোলাম মোস্তফার পরিবারে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহজাহান খান বলেন, ’৯৬ সাল থেকে দলকে সংগঠিত করে দৃঢ়ভিত্তিতে দাঁড় করিয়েছি। জয়ের অনুকূল অবস্থা থাকলেও কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরীর গ্রুপিংয়ের কারণে এখানে দলে নবীন গোলাম মোস্তফার ষড়যন্ত্রে বারবার পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। কথা হয় গোলাম মোস্তফার সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি’র জন্য আমি যা করেছি তা আর কেউ করেনি। আমি মনোনয়ন পেলে এখানে ধানের শীষই জিতবে। কে কি বলল না বলল তাতে আমার কিছু আসে যায় না।’ বর্তমান এমপি জাহাঙ্গীর হোসাইন দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক সরদার মো. শাহ আলম জানান, ’৯১ সাল থেকে জাহাঙ্গীর হোসাইন ৪ বার এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। তিনি সাধারণ মানুষের আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। গলাচিপার মানুষের প্রাণের দাবি ছিল জেলা সদর পটুয়াখালীর সঙ্গে পাকা সড়ক নির্মাণের। ‘৯৮ সালে প্রতিমন্ত্রী হয়ে গলাচিপা-পটুয়াখালী সড়ক এবং এ সড়কে কয়েকটি সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। তার বড় অবদান গলাচিপায় টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইন্সটিটিউট স্থাপন। এছাড়া রয়েছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার পাকা ভবনসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামীণ সড়কে পাকা সড়ক ও কালভার্ট নিমাণ। দলের প্রার্থী হিসেবে তাকে মনোনীত করা হলে আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে খ্যাত এ আসনটি সুরক্ষিত থাকবে।
আওয়ামী লীগের আরেক প্রার্থী অ্যাডখোকেট ফোরকান মিয়া বলেন, ‘অবশ্যই মনোনয়ন চাইব। না দিলেও দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করব।’ কথা হয় কামরান শাহিদ মহাব্বাতের সঙ্গে। তার দাবি, তিনিই এ আসনে একমাত্র কেন্দ্রীয় নেতা। তিনিই এর সর্বোচ্চ দাবিদার। তিনি বলেন, ১০ বছর ধরে আসনের অধিকাংশ মসজিদ, মন্দির ও গরিবদের মধ্যে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে নগদ টাকা দান করেছেন। গলাচিপা ডিগ্রি কলেজ মসজিদের ইমাম মাওলানা মো. নুরুজ্জামান জানান, মহাব্বাত ভাই মসজিদ ছাড়াও গরিব মানুষদের অর্থ ও চিকিৎসা সাহায্য করে সুনাম কুড়িয়েছেন।
এদিকে ৯১’র নির্বাচন থেকে দশম সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত ভোটের আধিক্যের কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সব সময়ই গলাচিপা উপজেলা থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। ফলে দশমিনার মানুষের মধ্যে রয়েছে অনেকটা না পাওয়ার আকাক্সক্ষা। বিএনপি যদি দশমিনার কাউকে মনোনয়ন দেয় তা হলে তাদের এতদিনের না পাওয়ার আকাক্সক্ষা আওয়ামী লীগের জন্য অশনি সংকেত বয়ে আনতে পারে। এ আসনে ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৬৪ হাজার ৯১৩ জন। গলাচিপা উপজেলা ও পৌরসভায় ১ লাখ ৭১ হাজার ৯১৩ এবং দশমিনায় ভোটার সংখ্যা ৯৩ হাজার ৬৫৪ জন। ২০০১ সালের ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসাইন প্রায় ১৩ হাজার ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। সূত্র বলছে, বিজয়ের নিয়ামক এ ১৩ হাজার ভোট এসেছিল দশমিনা, চরকাজল ও চরবিশ্বাস ইউনিয়ন থেকে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য হাসান মামুন জানান, ’৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী জয়ী হতে পারেনি। এবার সৃষ্টি হয়েছে মোক্ষম সুযোগ। দল যদি সঠিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয় তা হলে বিজয় অনেকটা নিশ্চিত বলে তিনি মনে করেন।
এ আসনে জয়ের পাল্লা আওয়ামী লীগেরই ভারি। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বারেক মিয়া, জিয়াউর রহমানের আমলে বিএনপির আবদুল বাতেন তালুকদার, এরশাদের আমলে ১৯৮৬ সালে অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, ’৮৮ সালে ইয়াকুব আলী চৌধুরী, ’৯১ সালে আওয়ামী লীগের আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন, ’৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপির শাহজাহান খান এবং একই বছর জুনে আওয়ামী লীগের আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন জয়লাভ করেন। পরে ২০০১ সালে জাহাঙ্গীর হোসাইন জয়লাভ করেন। তবে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন অপরিচিত গোলাম মাওলা রনি। পরে নানাভাবে তিনি আলোচিত-সমালোচিত হন। সর্বশেষ ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সংবাদ কর্মীদের মারধর করে তাকে জেলে যেতে হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আবার আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন জয়লাভ করেন। ১৫ আগস্ট পালন নিয়েও এলাকায় বিভক্তি লক্ষ্য করা গেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গলাচিপা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মজিবর রহমান জানান, ‘মনোনয়ন নিয়ে বড় দলে ছোটখাটো বিরোধ হতেই পারে। এটা খুবই সাময়িক। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আর নৌকার স্লোগান কানে গেলে সব বিরোধের অবসান হয়ে যায়।

Advertisement

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here