বর্মী ভাষায় ‘বাঙালি’ লেখা কার্ড নিতে মিয়ানমার সেনাদের হুমকি * ১৪টি গ্রামে বেপরোয়া লুটপাট
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে ফের বাঁধভাঙা ঢল নেমেছে। একদিনেই প্রায় অর্ধলাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সোমবার কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্ত দিয়ে এসব রোহিঙ্গা নাফ নদী পাড়ি দেয়। এদের অনেকে সীমান্তবর্তী আনজিমানপাড়ায় বিজিবির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে বেশির ভাগই ক্যাম্পসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। সোমবার আসা রোহিঙ্গারা জানান, তাদের দেশছাড়া করতে নতুন কৌশল নিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এখন আর তাদের ওপর আগের মতো শারীরিক নির্যাতন করা হচ্ছে না। সেনা সদস্যরা বর্মী ভাষায় ‘বাঙালি’ লেখা এক ধরনের কার্ড নিতে তাদের ওপর জোর-জবরদস্তি করছে। পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে ব্যাপক লুটপাট শুরু করেছে। এমনকি বাংলাদেশে চলে যেতে মাথায় বন্দুক তাক করে হুমকি দেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারের বুচিদং নয়ংশপাড়া গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষক হাফেজ ফয়েজ উল্লাহ (৪৮) জানান, তিনি নয়ংশপাড়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকতা করতেন। গত সপ্তাহের শুরুতে বর্মী সেনা ও রাখাইন যুবকরা মাদ্রাসাটি দখল করে সেখানে ক্যাম্প করে। ওই ক্যাম্পে রোহিঙ্গা লোকজনকে ধরে এনে বর্মী ভাষায় ‘বাঙালি’ লেখা কার্ড নিতে জোর-জবরদস্তি করছে। সেনাদের নতুন কৌশল অনুমান করতে পেরে শিক্ষিত রোহিঙ্গারা এসব কার্ড গ্রহণ করেনি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বর্মী সেনারা প্রায় ১৪টি গ্রামে বেপরোয়া লুটপাট শুরু করে। তারা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, ধান-চাল থেকে শুরু করে যা পেয়েছে তাই লুট করে নিয়েছে। বুচিদং মুরাপাড়া গ্রাম থেকে ৯ সদস্যের পরিবার নিয়ে পালিয়ে এসে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের আনজিমানপাড়া বেড়িবাঁধে আছেন মো. মিয়া (৫৮)। তিনি জানান, মিয়ানমার সেনারা এবার এক ধরনের সাদা কার্ড বিতরণ করছে। কার্ড না নিলে বন্দুক তাক করে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। এতে বুচিদংয়ের বাপিডিপো, নাইছাদং, চিংদং, লাউয়াদং, নয়াপাড়া, চান্দেরবিল, লম্বাবিল, জংমং ও প্রংফোপাড়াসহ প্রায় ১৪টি গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তিনি জানান, এসব গ্রামের প্রায় অর্ধলাখ বাসিন্দা সোমবার উখিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ৬ দিন ধরে পাহাড় ও বনজঙ্গল পেরিয়ে এদিন নাফ নদী পাড়ি দেন তারা। চান্দেরবিল গ্রামের আবদুল আমিন (৩৫) জানান, বুধবার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা মিয়ানমারের ফাতিয়ারপাড়া ঢালা নামক স্থানে জড়ো হন। পথিমধ্যে ফেলে আসা অন্য স্বজনদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তারা। শনিবার ভোররাতে মিয়ানমার সেনা ও সশস্ত্র রাখাইন যুবকরা তাদের অবস্থান লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। এ সময় দিগি¦দিক পালাতে গিয়ে ৫০ জন বয়োবৃদ্ধ নারী-পুরুষ গুরুতর আহত হয়েছেন। এছাড়া শতাধিক শিশু গর্ভবতি নারী নিখোঁজ হয়েছেন। তারা কোথায় আছেন বা বেঁচে আছেন কিনা তিনি জানেন না। এসব কথা বলতে গিয়ে আবদুল আমিনের দু’চোখ বেয়ে পানি নেমে আসে। আনজিমানপাড়ার বাসিন্দা ও উখিয়া ছাত্রলীগ নেতা মামুন নীলয় যুগান্তরকে বলেন, বিজিবি সদস্যরা আনজিমানপাড়ায় প্রায় ১৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ঘিরে রেখেছেন। তবে রোববার রাত থেকে পালিয়ে আসা বেশিরভাগ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্বজন ও আশপাশের বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। ৩৪ বিজিবির মেজর আশিকুর রহমান জানান, আনজিমানপাড়ায় ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা হতে পারে। তবে তিনি নির্দিষ্ট সংখ্যা বলতে পারছেন না। তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রত্যক্ষদর্শী পালংখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ মনজুর ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আলী আহমদ, পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী রোববার রাত থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢলের সত্যতা নিশ্চিত করেন। তবে তারা এদের সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেননি। স্থানীয় মেম্বার সোলতান আহমেদ জানান, কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের আনজিমানপাড়া পয়েন্ট দিয়ে রোববার রাতেই প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। আরও রোহিঙ্গা এপারে ঢুকতে মিয়ানমারের কুয়ান্সিবং সীমান্তে অপেক্ষা করছে বলে জানান তিনি।