মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ চলছে উল্লেখ করে অবিলম্বে এই সংকট নিরসনে মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসির নেতাদের ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মিয়ানমারে সেনাবাহিনী কী রকম নির্মমতা চালাচ্ছে, তা পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মুখ থেকেই শুনতে বিশ্বনেতাদের বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি।
কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নসহ ছয়টি প্রস্তাব তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। এ বিষয়ে ওআইসির যেকোনো উদ্যোগে অংশ নিতে বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে। ’
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনের ফাঁকে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিষয়ে ওআইসি কনট্যাক্ট গ্রুপের বৈঠকে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) মহাসচিব ইউসুফ আল ওথাইমেন। ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিরা ছাড়াও জাতিসংঘের মানবাধিকার সমন্বয়কারী বিষয়ক প্রধান মার্ক লোকক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন শেখ হাসিনা।
বৈঠকে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা এই জাতিগত নির্মূল অভিযানের অবসান দেখতে চাই।
আমাদের মুসলমান ভাই-বোনদের এই দুর্দশার অবসান চাই। এই সংকটের সূচনা হয়েছে মিয়ানমারে এবং সেখানেই এর সমাধান হতে হবে।
’
বৈঠকে দেওয়া শেখ হাসিনার ছয় দফা প্রস্তাব হলো : ১. রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সব ধরনের নিপীড়ন এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। ২. নিরপরাধ বেসামরিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য মিয়ানমারের ভেতরে নিরাপদ এলাকা (সেইফ জোন) তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে তাদের সুরক্ষা দেওয়া হবে। ৩. বল প্রয়োগের ফলে বাস্তুচ্যুত সব রোহিঙ্গা যেন নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে তাদের বাড়ি ফিরতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কফি আনান কমিশনের পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ৫. রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করার যে রাষ্ট্রীয় প্রপাগান্ডা মিয়ানমার চালাচ্ছে, তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ৬. রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে না ফেরা পর্যন্ত তাদের জরুরি মানবিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে হবে ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশগুলোকে।
বত্তৃদ্ধতার শুরুতেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মিয়ানমারে আজ রোহিঙ্গা মুসলমান ভাই-বোনেরা জাতিগত নির্মূল অভিযানের মুখোমুখি হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে পরিকল্পিত ও সংগঠিত প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের চালানো সামরিক অভিযান ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। অবিলম্বে এই নির্মমতা বন্ধ করতে হবে। ’
এ ঘটনায় এবারই সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘গত ২৫ আগস্ট থেকে চার লাখের বেশি মানুষ মিয়ানমার থেকে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এই আশ্রয়প্রার্থীদের ৬০ শতাংশই শিশু। এটা এক অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয়। আমি নিজে তাদের কাছে ছুটে গেছি, তাদের মুখ থেকে বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ভয়াবহ দুর্ভোগের বিবরণ শুনেছি। আমি আপনাদের সবাইকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, আপনারা আসুন, এই আশ্রয়প্রার্থীদের মুখ থেকে শুনে যান, মিয়ানমারে কী রকম নির্মমতা চলছে। ’
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৫ আগস্ট কয়েকটি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে হামলার পর দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের গ্রামে গ্রামে নৃশংস অভিযান শুরু করে। সেনাবাহিনী কিভাবে গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ মারছে, ঘরের ভেতরে আটকে রেখে কিভাবে মানুষকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, লুটপাট চালিয়ে কিভাবে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, সেই বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বক্তব্যে।
তিন দশক ধরে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গার ভার বহন করে আসা বাংলাদেশে এই দফায় নতুন করে আরো প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই সংখ্যা ১০ লাখে ঠেকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। ভূমিস্বল্পতা আর সম্পদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশ তাদের আশ্রয়, খাবার আর জরুরি সহায়তা দিয়ে আসছে বলে ওআইসির বৈঠকে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো পর্যন্ত মুসলিম দেশগুলো থেকে বাংলাদেশকে মানবিক সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গারা ‘বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী’ বলে দাবি করছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। অথচ ঐতিহাসিক নথিপত্র বলছে, রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে শত শত বছর ধরে।
মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং তিন দিন আগেও তাঁদের সশস্ত্র বাহিনীর এক অনুষ্ঠানে দাবি করেন, রোহিঙ্গা বলে কোনো জাতিসত্তা মিয়ানমারে ‘কখনোই ছিল না’। যারা রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি করছে, তারা ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’। এ বিষয়ে মিয়ানমারের নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বক্তব্যে কান না দিতে আহ্বান জানান তিনি।
রাখাইনে এবারের সহিংসতা শুরুর পর মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি বলেন, নব্বইয়ের দশকে করা প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় ‘যাচাইয়ের মাধ্যমে’ বাংলাদেশে থাকা আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে নিতে তাঁর দেশ প্রস্তুত। কিন্তু এই আশ্রয়প্রার্থীদের ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে স্বীকার করে না নেওয়ায় এবং তাদের ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বিষয়টি ভাষণে এড়িয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি সমালোচিত হচ্ছেন।
বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিয়ানমার পরিকল্পিত ও সংগঠিত উপায়ে বল প্রয়োগের মাধ্যমে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বের করে দিচ্ছে। প্রথমত, তারা নিবন্ধিত জাতিগোষ্ঠীর তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়েছে। এরপর ১৯৮২ সালের আইনে তাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশেই আইডিপি ক্যাম্পে পাঠিয়েছে তারা। ’
রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ কূটনৈতিক তত্পরতা চালিয়ে গেলেও মিয়ানমার তাতে সাড়া দিচ্ছে না বলে মুসলিম দেশের নেতাদের জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আপনারা হয়তো মিডিয়ায় দেখেছেন, রোহিঙ্গারা যাতে তাদের নিজের দেশে ফিরতে না পারে সে জন্য সীমান্তজুড়ে ভূমি মাইন পুঁতে রাখছে মিয়ানমার। ’
পাকিস্তানের দ্য নিউজের খবরে বলা হয়, বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ওআইসিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহীদ খাকান আব্বাসিও। তিনি ওআইসিকে আশ্বস্ত করেছেন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাহায্য করার জন্য ওআইসি বা জাতিসংঘের যেকোনো মানবিক প্রচেষ্টায় পাকিস্তান অংশগ্রহণ করবে।
এসডিজি অর্জনে নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বারোপ একই দিন জাতিসংঘ সদর দপ্তরে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কিত জাতিসংঘ মহাসচিবের উচ্চপর্যায়ের প্যানেলের এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সবার জন্য টেকসই উন্নয়নের সফল বাস্তবায়নের জন্য নারীর ক্ষমতায়নে তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সমান সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরিবর্তনের অতি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হচ্ছে নারী। এ জন্য সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলসের (এসডিজি) সফল বাস্তবায়নে নারীর ক্ষমতায়নের বিকল্প নেই। সব ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বিশ্ব সবার জন্য টেকসই উন্নয়ন অর্জনে কার্যকরভাবে সফল হতে পারে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের উচ্চপর্যায়ের প্যানেলে সুপারিশ এগিয়ে নিতে ‘গ্রুপ অব চ্যাম্পিয়নস ফর উইমেনস ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট’ এবং ‘ইউএন উইমেন’ এই বৈঠকের আয়োজন করে। কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট রিকা লুুইস গুল্লারমো সলিস রিভেরা, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, আইএমএফ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টাইন লাগারদে ও ইউএন উইমেনের ফুমজিল স্লামবো-গচুকা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের ৭২তম অধিবেশনে যোগদানকারী রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মানে জেনারেল অ্যাসেম্বলি বিল্ডিংয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন।
জলবায়ু প্রশ্নে বৈশ্বিক চুক্তিগুলো সামনে এনে সুবিচারের আহ্বান জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ আয়োজিত পরিবেশবিষয়ক বৈশ্বিক চুক্তি সংক্রান্ত শীর্ষ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে আইনগতভাবে সম্পাদিত দৃঢ় ও কার্যকর বৈশ্বিক চুক্তিগুলো সামনে এনে সুবিচার নিশ্চিত করতে এবং তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য উন্নত দেশগুলোর নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে অভিযোজন ও প্রশমন কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দায়ীদের স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত চিহ্নিত করতে হবে।
শেখ হাসিনা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নয়নের অধিকার মোকাবেলায় একটি যথাযথ, ন্যায়সংগত ও টেকসই পদ্ধতি গ্রহণের জন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।পরে প্রধানমন্ত্রী বেকম্যান প্যালেসে যুক্তরাজ্য ও মাল্টার প্রধানমন্ত্রীর যৌথভাবে আয়োজিত কমনওয়েলথ দেশগুলোর প্রধানদের এক সংবর্ধনায় যোগ দেন। সন্ধ্যায় তিনি ম্যাডিসন এভিনিউতে প্যালেস হোটেলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আয়োজিত অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছেলে ও তাঁর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ছিলেন।