কুমিল্লায় অর্ধশতাধিক মৃত ব্যক্তিসহ ১৬০ জনের নামে বয়স্ক, বিধবা ও পঙ্গুভাতা তুলে আত্মসাৎ করেছেন ইউপি সদস্য ফরিদ উদ্দিন। পাঁচ বছর ধরে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা উত্তোলন করেন তিনি। এর মধ্যে সামান্য কিছু টাকা দুস্থদের দিয়ে সিংহভাগই ভরেন নিজের পকেটে।
ফরিদ উদ্দিন মুরাদনগর উপজেলার শ্রীকাইল ইউপির ৬নং ওয়ার্ডের সদস্য। স্থানীয়দের অভিযোগ, এ দুর্নীতির সঙ্গে ওই ইউপির চেয়ারম্যান আবুল হাসেম বেগ ও সোনালী ব্যাংক শ্রীকাইল শাখার কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদও জড়িত রয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দুস্থ ভাতার জন্য কার্ডধারী ব্যক্তিকে সশরীরে ব্যাংকে হাজির হয়ে টাকা উত্তোলন করতে হয়। কিন্তু ওই ১৬০ জনের কার্ডে একাই সব টাকা তুলতেন সদস্য ফরিদ উদ্দিন। অন্যদিকে সব কার্ডের বিপরীতে টাকা উত্তোলন শিটে একাই টিপসই দেন স্থানীয় চৌকিদার শিপারুল হক ভুঁইয়া।
চৌকিদার শিপারুল হক ভুয়া টিপসই দেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘ফরিদ মেম্বারের নির্দেশে আমি টিপসই দেই।’
অভিযোগ উঠেছে, সবকিছু জেনেও ‘বিশেষ স্বার্থে’ চুপ ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাসেম বেগ। অন্যদিকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একজনের হাতেই দেড় শতাধিক দুস্থ ব্যক্তির ভাতা তুলে দিতেন ব্যাংক কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ। এতে তার পকেটও ভারি হতো বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মেম্বার ফরিদ উদ্দিন ভুতাইল, সাহগোদা ও মনোহরাবাদ গ্রামের ১৬০ জন হতদরিদ্র লোকের নামে বয়স্ক, বিধবা ও পঙ্গুভাতার কার্ড তৈরি করে নিজের কাছেই সংরক্ষণ করেন। ছয় মাস অন্তর অন্তর এসব কার্ডের বিপরীতে ভুয়া টিপসই দিয়ে পাঁচ বছর ধরে টাকা উঠিয়ে আসছেন তিনি। এভাবে প্রতি বছর ২ কিস্তিতে প্রায় ৯ লাখ টাকা করে পাঁচ বছরে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা উত্তোলন করেন।
বিধি অনুযায়ী, বয়স্ক ও বিধবা ভাতা প্রদানের জন্য একজন ইউপি সদস্য তার ওয়ার্ডের নির্দিষ্ট ব্যক্তি শনাক্ত করে কমিটির সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে প্রস্তাব পাঠাবেন। চেয়ারম্যান তা যাচাই-বাছাই করে কার্ডে স্বাক্ষর করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করে নিজ স্বাক্ষর ও টিপসইয়ের মাধ্যমে ভাতা উঠাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো নিয়মই মানা হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, ওই ১৬০ জনের মধ্যে ভুতাইল গ্রামের নসু সরকার, আনছর আলী, আনোয়ারা বেগম, আছিয়া খাতুন, আবদুল মান্নান, ফরিদ মিয়া, রুজিনা খাতুন, ইদন মিয়া, জুলেখা খাতুন, মজিদ মিয়া, ফুলেছা বেগম, জোবেদা খাতুন, সাহেরা খাতুন, হাফেজা খাতুন, সাফিয়া খাতুন, সুখিলা বেগম, আবদুল বারিক, বাবর আলীসহ অর্ধশতাধিক ভাতাভোগী কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। মৃত এসব ব্যক্তির নামেও টাকা উঠিয়ে আত্মসাৎ করেন মেম্বার ফরিদ।
ভুতাইল গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, ফরিদ মেম্বারকে বহুবার বলা হয়েছে, গরিবদের ভাতার কার্ডগুলো ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি কারও কথা শোনেনি।
একই গ্রামের কবির মিয়া জানান, তার মা আছিয়া খাতুন ২ বছর ৭ মাস আগে মৃত্যুবরণ করলেও তার মায়ের বিধবা ভাতার কার্ডটি এখনও সচল রেখেছেন মেম্বার। ওই গ্রামের কমল সরকার বলেন, আমার নানা নসু সরকার ৩ বছর আগে মারা যান। ফরিদ তার কার্ডেও ভাতা তুলে আত্মসাৎ করেন।
এ ব্যাপারে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বশির আহাম্মদ বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে মেম্বার ফরিদ অসহায় গরিবদের ভাতার কার্ড আটকে রেখে অর্থ আত্মসাৎ করছে। প্রতিদিনই ভুক্তভোগীরা অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে আসছে। আমরা তাদের ভাতার টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিয়ে আসছি, কিন্তু সে আমাদের কথায় তোয়াক্কা করছে না।
অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাশেম বেগ বলেন, আমি সভাপতি হিসেবে কার্ডে স্বাক্ষর করেছি মাত্র, ভাতা আত্মসাতের সব দায়ভার ইউপি সদস্য ফরিদ উদ্দিনের।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত মেম্বার ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘আমি যাদের কার্ড আটকে রেখে টাকা উত্তোলন করেছিলাম বেশিরভাগ লোকের অর্থই পরিশোধ করে দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘পর্যায়ক্রমে অন্যদের টাকাও আমি পরিশোধ করে দেব।’
মৃত ব্যক্তিদের নামে প্রতারণা করে অর্থ উঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব কার্ড আমি পরিবর্তন করে অন্যদের নামে করে দেব।’
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আবু তাহের বলেন, মৃত ব্যক্তিদের নামে ভাতা উত্তোলন করে আত্মসাতের বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। তবে এ বিষয়ে তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত নেয়া হবে।