খাদ্য গুদামের চাল আটা নিতে চায় না পুলিশ নিজম্ব ব্যবস্থাপনায় কেনার উদ্যোগ * এই চাল আটা নোংরা, কাঁকর ও দুর্গন্ধযুক্ত

0
445

সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে সরবরাহ করা রেশনের চাল ও আটা নিতে চায় না পুলিশ। পুলিশের ভাষায়, খাদ্য গুদাম থেকে যে চাল ও আটা সরবরাহ করা হয় সেগুলো স্বাদহীন, নোংরা, কাকর ও দুর্গন্ধযুক্ত। বিদেশ থেকে আমদানি করা চাল খুবই ন্মিনমানের। এগুলো খাওয়ার উপযুক্ত নয়। খাদ্য গুদাম থেকে যে গম সরবরাহ করা হয় সে গমের আটা ৪-৫ দিনের বেশি মজুদ রাখলে পোকা হয়ে যায়। এগুলো খেয়ে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। পুলিশের স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পুলিশ সদর দফতর থেকে চিঠি দিয়ে এরই মধ্যে খাদ্য গুদামের চাল ও গম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। তাই পুলিশের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চাল ও গম কেনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে চিঠি দেয়া হবে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছেন পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছে।

Advertisement

সূত্র জানায়, খাদ্য গুদাম থেকে চাল ও আটা সংগ্রহের ক্ষেত্রে ওয়ারেন্টি প্রথা (যে চাল আগে গুদামে প্রবেশ করেছে, আগে সে চাল নিতে হবে) চালু রয়েছে। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এ প্রথা কার্যকর নয়। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা গুদাম থেকে নিজেদের পছন্দসই চাল সংগ্রহ করতে পারেন। তাই পুলিশ তাদের জন্য ওয়ারেন্টি প্রথা শিথিল করতে জন্য দীর্ঘদিন ধরে বারবার সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন জানাচ্ছিলেন। গত পুলিশ সপ্তাহেও এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। কিন্তু ওই প্রথাটি শিথিল না হওয়ায় পুলিশের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। এখন আর পুলিশ ওয়ারেন্টি প্রথা শিথিল করার কথা বলছে না। তারা এখন অন্যান্য রেশন পণ্যের মতো (চিনি ছাড়া) টেন্ডারের মাধ্যমে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কিনতে চায়।

সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম সুজনের এক প্রশ্নের জবাবে সংসদের প্রধানমন্ত্রী প্রশ্নোত্তরের জন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে সরবরাহ করা এক বক্তব্যে ৬ সেপ্টেম্বর বলা হয়, পুলিশ বাহিনীর জন্য সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে যে চাল সরবরাহ করা হয়, তার মান বাজারের চালের চেয়ে ন্মিন। পুলিশ বাহিনীর জন্য ওয়ারেন্টি প্রথা শিথিল থাকলে খাদ্য গুদাম থেকে ভালো মানের চাল উত্তোলনের সুযোগ থাকত। খাদ্য গুদামের চাল পুলিশ বাহিনীকে আধুনিকায়ন ও গতিশীল করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে বলে পুলিশ সদর দফতর জানায়।

চলতি জাতীয় সংসদের ১৬তম অধিবেশনে ঢাকা-১ আসনের সংসদ সদস্য সালমা ইসলামের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তরের জন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে সরবরাহ করা এক বক্তব্যে ৫ জুন বলা হয়, খাদ্য গুদাম থেকে চাল ও গম উত্তোলনের ক্ষেত্রে কতিপয় ইউনিটের জন্য ওয়ারেন্টি প্রথা শিথিল থাকায় তারা ভালো মানের চাল-গম উত্তোলনের সুযোগ পায়। কিন্তু পুলিশের জন্য এ সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে পুলিশকে খাওয়ার অনুপযোগী চাল-গম উত্তোলন করতে হচ্ছে। ১৪তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রশ্নের জবাব লিখতে গিয়ে ১৯ জানুয়ারি পুলিশ সদর দফতর জানায়, রেশনের চাল ও গম খাদ্য গুদাম থেকে উত্তোলনের জন্য পুলিশের ক্ষেত্রে ওয়ারেন্টি প্রথা শিথিল করতে কয়েক দফা পত্রালাপ করেও আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। পুলিশের জন্য উন্নত মানের চাল ও গম সরবরাহ করা হলে পুলিশ সদস্যদের স্বাস্থ্যের উন্নতির পাশাপাশি মনোবল বৃদ্ধি পাবে। একই অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর জন্য এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাব লিখতে গিয়ে ১৭ জানুয়ারি একই ধরনের তথ্য জানায় পুলিশ সদর দফতর।

গত বছরের ১৭ জুলাই জেলা প্রশাসক সম্মেলনে টকিং পয়েন্ট হিসেবে খাদ্য গুদামের চালের বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, পুলিশের ১২২টি ইউনিট থেকে মতামত সংগ্রহ করে জানা গেছে, খাদ্য গুদামের চাল অত্যন্ত মোটা, দুর্গন্ধযুক্ত ও খাবার অনুপযোগী। এ চাল খেয়ে পুলিশের পক্ষে নিরলসভাবে ১৬-১৭ ঘণ্টা কাজ করা প্রায় অসম্ভব। পুলিশের কাজের পরিধি ও কর্মস্পৃহার বিষয়টি বিবেচনায় বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখা উচিত। পুলিশের শারীরিক ও মানসিক উন্নতির লক্ষ্যে চাল ও গমের মান উন্নত হওয়া উচিত বলে টকিং পয়েন্টে বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, রেশনের চাল ও গম খাদ্য গুদাম থেকে না নিয়ে ডাল ও তেলের মতো উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কেনার ব্যবস্থা করা হলে উন্নত মানের চাল ও গম সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।

২০১৫ সালের ৫ আগস্ট পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এ আইজি রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত স্বরাষ্ট্র সচিবকে দেয়া এক চিঠিতে বলা হয়, খাদ্য গুদাম থেকে উন্নত মানের চাল ও গম সরবরাহের বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পত্রালাপের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুনরায় বিশেষভাবে অনুরোধ করা হল। ২০১৫ সালের ২৮ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেয়া এক চিঠিতে পুলিশ সদর দফতর জানায়, অপেক্ষাকৃত উন্নত মানের খাদ্যশস্য সরবরাহের বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশ থাকলেও দেশের কোনো সরকারি খাদ্য গুদাম থেকেই সে অনুযায়ী চাল-গম সরবরাহ করা হচ্ছে না। ২০১০ সালের ২০ এপ্রিল পুলিশ সদর দফতরের এআইজি শোয়েব আহাম্মদ স্বাক্ষরিত এক পত্রে স্বারষ্ট্র সচিবকে একই ধরনের তথ্য জানানো হয়েছিল। ২০১৪ সালের ২৩ মার্চ পুলিশ সদর দফতরের এআইজি মো. সরওয়ার স্বাক্ষরিত এক পত্রে জানানো হয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় ২০১২ সালের এক অফিস আদেশে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারেন্টি প্রথা কিছুটা শিথিল করায় ডিএমপির মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১ সালের ১৩ জুন পুলিশ সদর দফতরের এআইজি শোয়েব আহাম্মদ স্বাক্ষরিত এক পত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়, খাদ্য গুদাম থেকে সরবরাহ করা চাল ও গম খেয়ে পুলিশ সদস্যরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এতে পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়ছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রভাব ফেলছে। পত্রে আরও বলা হয়, ওএমএস কার্যক্রমে যে চাল সরবরাহ করা হয়, একই চাল পুলিশকে সংগ্রহ করতে হয় খাদ্য গুদাম থেকে। গুদামে থাকতে থাকতে চালের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। সিস্টেমের কারণেই খাদ্য গুদাম থেকে কয়েক বছর বা মাসের পুরনো চাল সংগ্রহ করতে হয়। খাদ্য গুদামের চাল-গমের বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা পুঞ্জীভূত হয়ে সামগ্রিক বিষয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলেও ওই পত্রে আশঙ্কা করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে পুলিশের জন্য বছরে প্রায় ৬৮ হাজার মেট্রিক টন চাল ও ৬০ হাজার মেট্রিক টন গম সরবরাহ করা হয় সরবরাহ করা হয়। প্রতি কেজি চাল ৩৭ টাকা ও প্রতি কেজি গমের মূল্য নেয়া হয় ২৯ টাকা। বছরে গড়ে ৪৮০ কোটি টাকার চাল-গম পুলিশকে সরবরাহ করা হয়। এসব চাল খাবার অনুপযোগী বিবেচনায় বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য তা প্রতি কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি করে দেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব চাল ও গম বিক্রি করা হয় খাদ্য গুদামের একটি সিন্ডিকেটের কাছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের নিচের পর্যায়ের পুলিশ সদস্য বা ন্মিন আয়ের মানুষ তা কিনে নেয়। যেসব পুলিশ সদস্য রেশনের চাল বিক্রি করছেন তারা বেশি দামে বাইরে থেকে কিনে খাচ্ছেন। পুলিশ রেশন হিসেবে অন্য যেসব পণ্য পেয়ে থাকেন সেগুলো হল- চিনি, মসুর ডাল, তেল এবং পোলাওয়ের চাল। এসবের মধ্যে চিনি সরবরাহ করে চিনি শিল্প কর্পোরেশন। চিনির মান নিয়ে পুলিশের কোনো প্রশ্ন নেই। ডাল, তেল ও পোলাওয়ের চাল পুলিশ টেন্ডারের মাধ্যমে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কিনে থাকে। তাই এসবের মান নিয়েও তাদের কিছু বলার নেই।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি রেজাউল করিম  বলেন, সার্বিক বিষয় বিবেচনায় পুলিশের পক্ষ থেকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চাল ও গম কেনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের অনুমতি পাওয়া গেলেই বিষয়টি কার্যকর করা হবে। এটি হলে সাধারণ লোক টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে চাল সরবরাহের সুযোগ পাওয়া যাবে। দেশের বাইরে থেকে চাল আমদানি করতে হবে না। কৃষক চালের ন্যায্য দাম পাবে।

Advertisement

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here