কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : কুষ্টিয়া সদরের খামারি আরিফুল ইসলাম (৪২)। গত বুধবার ১৪টি গরু নিয়ে রাজধানীর একমাত্র স্থায়ী পশুর হাট গাবতলীতে এসেছেন। এর মধ্যে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত তিনটি গুরু লোকসানে বিক্রি করেছেন। প্রতিটা গরুতে টার্গেটের থেকে ২০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে আরিফুলের। তিনটি গরুতে প্রায় ৬০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে তার। বাকি ১১টি গরুর দামও তেমন উঠছে না।
সাড়ে তিন মণ মাংস পাওয়া যাবে এমন প্রতিটা গরু ৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন তিনি। অথচ খামারি আরিফুল আশা করছিলেন, কোরবানি উপলক্ষে প্রতিটা গরু ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকায় বিক্রি হবে।
লোকসানে গরু বিক্রি প্রসঙ্গে খামারি আরিফুল বলেন, ভারতের গরু বেশি বেশি আসাতে আমাদের এ দুর্গতি। সরকার খামার করার জন্য উৎসাহিত করেছে। আমরাতো অনেক টাকা পয়সা খরচ করে গরু পালছি, সরকার লোনও দেচে। আমরা খামার করছি বাজারে গরু আনছি। আপনারা একটু বাজার ঘুইরি দ্যাকেন ভারতের গরুতে ভইরে গেচে। বাজারে সব ভারতের গরু। আমরাই শুধু এই দ্যাশাল গরুনি পইড়ি রইচি। যারা খামার করচে তারাই একানে আসচে।
তিনি আরো বলেন, ১৪টা গরু নিয়া আইচি। তার ভেতর তিন গরু লচে (লোকসান) বিক্রি করচি। গরু প্রতি ২০ হাজার ট্যাকা লচ। বাকি গরু দামই বলছে নাকো। সব খদ্দির (ক্রেতা) ভারতের গরুর আশায় আশায় বইসে রইচে। আমাদের দ্যাশাল গরু যেন বেদামি।
…দেশীয় খামারিরা জানান, মিনিকেট চালের খুদ, এক নম্বর খৈল, ভাতের মাড়, সিদ্ধ ভাত, খেসারির ভূষি, গমের ভূষি, বুটের ভূষি গরুকে খাওয়ানো হয়েছে। এসব খাদ্যের দাম গড়ে ৪০ টাকা কেজি। এর উপরে শেষ সময়ে ভারতের গরু আসায় বিপদে পড়েছেন দেশি খামারি-চাষিরা।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে দু’টা চার দাঁতের ষাড় গরু গাবতলী হাটে এনেছেন চাষি খাদেমুল ইসলাম। দেশি গরুর দাম কম হওয়ায় মাথায় হাত তার।
খাদেমুল বলেন, একবেলা নিজে খাইনি, গরুক খাওয়াইচি। বড় যত্নের গরু। হাটে তুইলে যতি (যদি) দাম কম হয় তাহলে চাষি বসান খাইয়ে (লোকসান) শ্যাষ হইয়া যাবে ইবারও (এবার)। যাগের (যাদের) পয়সা আচে তারাই কুরমানি (কোরবানি) দেয়, তারা যতি (যদি) ২০ হাজার ট্যাকা বেশি দেয় সমেস্যা নাই। কিন্তুক আমাগের মতো চাষির ২০ লচ হইলে বিরাট সমেস্যা।’
রাজধানীর একমাত্র স্থায়ী পশুরহাট গাবতলীতে কোরবানির পশু আসা শুরু করেছে। তবে ক্রেতা কম হওয়ায় হাট এখনও জমেনি। হাট জমতে আরও তিন থেকে চারদিন লাগবে। তবে শুক্রবার হাটে গিয়ে দেখা গেছে, ভারতীয় গরুতে পুরো গাবতলী সয়লাব। এছাড়া ভারতীয় মহিষও গাবতালী হাটের এক অংশ দখল করে নিয়েছে। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে বৈধ ও অবৈধ উভয় পথেই এসব গরু গাবতলীতে উঠেছে।
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলার সীমান্ত পথে এক সপ্তাহ ধরে গরু আসার সংখ্যা বাড়ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বেশি আসছে ভারতীয় গরু-মহিষ। এছাড়া রাজশাহী, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম ও সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে গরু এসেছে বলে জানায় গাবতলীর হাটের ভারতীয় গরু ব্যবসায়ীরা।
ভারতীয় গরুর কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে দেশীয় খামারি-গৃহস্থরা। যেমন, বৃহস্পতিবার মানিকগঞ্জের ব্যাপারি আব্দুর রশিদ ৫০টা ভারতীয় গরু গাবতলীর হাটে এনেছেন। এর পাশেই সাভারের সিদ্দিক মুন্সি ব্যাপারি প্রায় শতাধিক ভারতীয় গরু হাটে তুলেছেন।
গাবতলী হাটে যেমন মেলা বসেছে ভারতের বড় বড় সাদা বলদ গরুর। প্রতিটা গরুর গায়ে করিডোর সিল দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে দেশে প্রবেশ করেছে এসব গরু। ভারতীয় গরুর বেপারিরা জানায়, ভারতের উড়িষ্যা ও বিহার থেকে বড় বড় সাদা বলদ গরু এসেছে গাবতলীর হাটে।
দেশীয় খামারিরা ভারতীয় গরুর জন্য বিপদে পড়ছেন একথা অকপটে স্বীকার করছেন সেদেশের গরুর বেপারিরাও।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ গোমস্তাপুরে চাঁন মিয়া বেপারি। প্রায় ২০ বছর ভারতীয় গরুর ব্যবসায় জড়িত তিনি। দেশীয় খামারিদের সমস্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিট দিয়া ভারতের গরু কিছু কিছু আসছে। ভারতের গরুতে বিরাট সমস্যায় পড়বে দ্যাশাল খামারি অলারা। আমারে বিরাট বিরাট গরুর কারণে দ্যাশাল গরুর দাম বুইলছে নাকো। আমার গরু বিকরি হইলে হইলো নাইলে লিয়া চইলে গেনু (গেলাম)। কিন্তু দ্যাশাল খামারির গরু এক পিশ (একটা) ঘুইরে গ্যালেইতো সমস্যা।’
গত তিনটা কোরবানিতে লোকসান গুণতে হয়েছে দেশীয় খামারি-গৃহস্থদের। এবারও ভারতীয় গরুর কারণে একই অবস্থা। অন্তত কোরবানির সময় ভারতের গরু আমদানি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন খামারি-গৃহস্থরা।