গাজীপুর শিল্প এলাকায় গ্যাসের ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে এক মাস ধরে গ্যাসের অব্যাহত সংকটে শিল্প-কলকারখানার উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। চরম ক্ষতির মুখে পড়ছে গ্যাসনির্ভর ছোট-বড় শিল্পকারখানাগুলো। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বারবার আশ্বাস দিলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
গ্যাসের অভাবে সফিপুর ও কোনাবাড়ীসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থিত শিল্পকারখানা দিনের বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এ কারণে প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার পণ্য উৎপাদনে চরম বিঘœ ঘটছে। এভাবে চলতে থাকলে লাভ তো দূরের কথা, রফতানিমুখী বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান লোকসানের মুখে পড়বে।
সরেজমিন কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, ভোগড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা গল্পগুজব করে অলস সময় পার করছেন। গ্যাসের চাপ না থাকায় কারখানার মেশিনের চাকা ঘুরছে না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। গ্যাস সংকটে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধের উপক্রম হয়েছে। কিছু কারখানা বিকল্প ব্যবস্থায় উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রাখলেও তারা মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে।
বিভিন্ন শিল্পমালিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এক মাস ধরে কোনাবাড়ী, বাইমাইল, বিসিক, জরুন, কাশিমপুর, কালিয়াকৈরের মৌচাক, সফিপুর, সিনাবহ, চন্দ্রাসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে ওই এলাকার বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানায় মারাত্মকভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কোনাবাড়ী এলাকার কয়েকটি কারখানা পরিদর্শন করে দেখা যায়, গ্যাসের সংকটে দিনে কয়েকবার উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
একটি গার্মেন্ট কারখানায় তাদের খাতায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় লিখে রাখা গ্যাসের প্রেসার সংক্রান্ত রিডিংয়ে দেখা যায়, সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত গ্যাসের প্রেসার (চাপ) ছিল শূন্য পিএসআই, ১০টা থেকে বেলা ১২টা ২ দশমিক শূন্য পিএসআই আর বেলা ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত ২ দশমিক ৫ পিএসআই। অথচ কারখানাটি পুরোদমে উৎপাদন করতে ৮ থেকে ১০ পিএসআই প্রেসার প্রয়োজন। কারখানার কর্মকর্তারা জানান, গ্যাসের প্রেসার দিনে ৮-১০ বার ওঠানামা করে। এ সময় তাদের উৎপাদনও বন্ধ রাখতে হয়। মূল লাইনে যেখানে এক হাজার পিএসআই চাপ থাকে, সেখানে থাকছে মাত্র ৫০ পিএসআই।
এক কারখানা কর্তৃপক্ষ জানান, গ্যাসের প্রেসার ৪-৫ পিএসআই থাকলে অর্ধেক কারখানা বন্ধ রেখে বাকি অর্ধেক দিয়ে কোনোমতে উৎপাদন চালিয়ে নেয়া যায়। এতে অর্ডার সরবরাহ করতেও তাদের হিমশিম খেতে হয়। এজন্য তাদের ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যারা কারখানা চালু করেছেন, তারা খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। উৎপাদন কমে যাওয়ায় শ্রমিকের মজুরিও কমে গেছে। এতে শ্রমিকদের মধ্যেও হতাশা বিরাজ করছে। গ্যাস সংকটে বিভিন্ন শিল্পকারখানার উৎপাদন ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কমে গেছে।
কালিয়াকৈর উপজেলার কারখানার মালিকরা চাহিদা মতো তিতাস গ্যাসের প্রেসার না পাওয়ায় তাদের উৎপাদনও চরম ব্যাহত হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাস না পেয়ে অধিকাংশ সময় কারখানা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু রাখা হচ্ছে। এতে খরচ পড়ছে অনেক বেশি। ফলে প্রতিযোগিতার বাজারে বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্যের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।
কারখানা মালিক ও কর্মকর্তারা জানান, গ্যাস সংকটের জন্য কালিয়াকৈরের পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার স্পিনিং, টেক্সটাইলসহ শত শত কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অনেক কারখানায় শ্রমিকদের বেতন উৎপাদনের ভিত্তিতে দেয়া হচ্ছে। পুরোমাত্রায় কাজ চললে যে শ্রমিক ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা মজুরি পেতেন, গ্যাস সংকটে কাজ কমে যাওয়ায় এখন পাচ্ছেন ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে শ্রমিকদের। শ্রমিকরা জানান, গ্যাস না থাকায় বাসায় ফিরে রান্নাও করা যাচ্ছে না। অনেকে চড়া দামে লাকড়ি ও কেরোসিন কিনে রান্না করতে বাধ্য হচ্ছেন। কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, মির্জাপুর, ভোগড়া, বাসন ও গাছা এলাকায় তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, স্পিনিং, নিট কম্পোজিট, ওষুধ, সিরামিক, লেদার, রি-রোলিংসহ সাত সহস্রাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। উৎপাদন ও মজুরি কমে যাওয়ায় মালিক ও শ্রমিক উভয়ের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। রফতানিমুখী বড় বড় প্রতিষ্ঠান টিকে থাকলেও ছোট কারখানার মালিকদের বিনিয়োগ হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীদের কয়েকজন বলেন, গ্যাস না পেয়ে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ডিজেলের ব্যবহার বাড়ায় কারখানাগুলোয় পণ্যের উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত, রফতানিমুখী পোশাক কারখানাগুলোয় এ সংকট চরম রূপ নেয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে তিতাসের গাজীপুর অফিসের ম্যানেজার সুরুজ আলম জানান, তারা তিতাসের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছেন না। এ কারণে দিনে গ্যাসের চাপ থাকে না। তিনি বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন বিদ্যুৎ ও সার কারখানা চালু থাকায় ওইসব কারখানায় অতিরিক্ত গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে গাজীপুর এলাকায় এ সংকট দেখা দিয়েছে।