ধান-চাল ক্রয়ে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এ ঋণ ৩০ দিনের মধ্যে সমন্বয়ের নির্দেশনা থাকলেও তা মানছেন না অনেক ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি না থাকায় ঋণ সমন্বয়ে ব্যাংকগুলোরও কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেই। এ অবস্থায় ঋণ নিয়ে চাতাল মালিকরা গড়েছেন মাত্রাতিরিক্ত মজুদ। এভাবে কৃত্রিম উপায়ে চালের সংকট তৈরি করে মুনাফা লুটার কৌশল নিয়েছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।
এসব অনিয়ম খতিয়ে দেখার কথা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু অনিয়ম রোধে পরিদর্শকদের ক্ষমতা কমানোর সাম্প্রতিক এক চিঠিকে ইস্যু করে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন কর্মকর্তারা। সে কারণে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত পরিচালনা করা হয়নি। পরিদর্শকরা মাঠপর্যায়ে যেতে পারছেন না। এ সুযোগে অবৈধ মজুদ গড়ে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, ধান-চাল ব্যবসায়ী ও চাতাল বা মিল-মালিকরা ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদি প্লেজ ও সিসি হাইপো ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেন। ঋণ নিয়ে কেউ যেন ধান-চাল মজুদ করতে না পারেন, এ কারণে ৩০ দিনের মধ্যে এ ধরনের ঋণ পরিশোধের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্ধারিত সময়ে ঋণ সমন্বয়ের চাপ থাকলে ব্যবসায়ীরা ধান থেকে চাল উৎপাদনের অল্পদিনের মধ্যে বাজারজাত করতে বাধ্য হন। আর ওই চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যেই এর আগে চালের দামে অস্বাভাবিকতা দেখা দিলেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল মাঠপর্যায়ে গিয়ে পরিদর্শন করত। কিন্তু এবার সেটা হয়নি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা যুগান্তরকে বলেন, চালের বিপরীতে দেয়া ঋণ যথাসময়ে সমন্বয় না করলে মজুদদারীর সুযোগ তৈরি হয়। ব্যাংক যথাসময়ে ঋণ সমন্বয় করছে কিনা, যখন যে প্রতিনিধি দল যে ব্যাংকে যায়, তারা তা দেখে। আদায় অগ্রগতি অনুযায়ী শ্রেণীকরণ করা হয়। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পরামর্শ দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে তদন্ত পরিচালনা করা হবে। চিঠির ঘটনা এখানে প্রযোজ্য নয় বলে জানান তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শন বিভাগে কাজ করেন এ রকম একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, এর আগে চালের বাজারে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলেই ঋণ সমন্বয়ে মাঠপর্যায়ে গিয়ে তারা পরিদর্শন করতেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল যখন যে এলাকায় কাজ করত, তারা ওই অঞ্চলের ব্যাংক শাখা পরিদর্শন করতেন। অনেক সময় পরিদর্শনের জন্য নতুন প্রতিনিধি দল গঠন করে বিশেষ অঞ্চলে পাঠানো হতো। তবে ২৩ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামানের নির্দেশনার ফলে এখন আর আগের মতো মাঠপর্যায়ে পরিদর্শনে যেতে পারছেন না।
ব্যাংক ও চাতাল মালিক সূত্র জানায়, বছরে ধান-চাল সংগ্রহে গড়ে একজন মিলার গড়ে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে থাকেন। ফলে এ খাতে বছরে ব্যাংক ঋণ সরবরাহের হার ৯ হাজার কোটি টাকার কম হবে না। এ খাতে ব্যাংক ঋণে অনিয়মের বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে। একই অনিয়ম ২০১৩ ও ২০১৫ সালেও পরিলক্ষিত হয়। তখন বেশকিছু ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, প্লেজের বিপরীতে নেয়া ঋণের মাধ্যমে গুদামজাত পণ্যের ওপর ব্যাংক ও ব্যবসায়ী উভয়ের নিয়ন্ত্রণ থাকে। গুদামের চাবি ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়ের কাছে থাকে। তবে এর আগে অনেক ব্যবসায়ীর ব্যাংকের অগোচরে পণ্য বিক্রি করে দেয়ার নজির রয়েছে। ফলে এখন প্লেজের তুলনায় ব্যাংকগুলো সিসি হাইপো ঋণ বেশি দিয়ে থাকে। সিসি হাইপো ঋণের বিপরীতে গুদামজাত পণ্যের ওপর একক নিয়ন্ত্রণ থাকে ব্যবসায়ীর। তবে পণ্য বিক্রি করে নির্ধারিত সময়ে ব্যাংকের টাকা পরিশোধের জন্য গ্রাহকের সঙ্গে চুক্তি থাকে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে ১৭ হাজার চাতাল ও হাস্কিং মিল এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সোয়া তিনশ’ অটোরাইস মিল সক্রিয় রয়েছে। এদের নিজস্ব পুঁজি কম। মৌসুম এলেই এরা হাত পাতেন ব্যাংকের কাছে। মাঝারি মানের চাতাল মালিকরা প্রতি মৌসুমে গড়ে ৫০ লাখ থেকে কোটি টাকা এবং বড়রা ৫ কোটি থেকে আড়াইশ’ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যাংক ঋণ নিচ্ছেন।