চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে গণহত্যা বন্ধে কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব পাশ ছাড়াই শেষ হয়েছে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক। বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে এ বৈঠক হয়। নিরাপত্তা পরিষদের সাতটি সদস্য রাষ্ট্র যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সেনেগাল, মিসর, সুইডেন, ফ্রান্স ও কাজাখস্তান জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবকে মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতির ওপর নিরাপত্তা পরিষদে বিবৃতি প্রদানের অনুরোধ জানায়। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের বিবৃতির পর পরিষদের ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত মানবিক বিপর্যয় ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে এ বৈঠকে বক্তব্য উপস্থাপন করেন জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। বাংলাদেশ ছাড়া নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রের বাইরে এ সভায় বক্তব্য দেন মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও স্টেট কাউন্সেলর বিশেষ দূত ইউ থাং তুন। বৈঠকের শুরুতেই মিয়ানমারের সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরে বক্তব্য দেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব আন্তেনিয়ো গুতেরাস। এ সময় তিনি বলেন, মিয়ানমারে সহিংসতা বর্তমানে বিশ্বের দ্রুততম শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি করেছে যা মানবাধিকার পরিস্থিতিকে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় নিয়ে গেছে। মিয়ানমারে সহিংসতা মানবাধিকারের জন্য দুঃসপ্ন বলেও মন্তব্য করেন মহাসচিব। বৈঠকে মহাসচিব মিয়ানমার সরকারের প্রতি তিনটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, প্রথমত রাখাইন প্রদেশে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে হবে, দ্বিতীয়ত আক্রান্ত এলাকায় মানবিক সহযোগিতা পৌঁছানোর সুযোগ দিতে হবে, তৃতীয়ত কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়বার ব্যবস্থা করতে হবে। জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সেনাবাহিনীর যথাযথ জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত দেশটিতে সব ধরনের অস্ত্র বিক্রি বন্ধ রাখতে হবে। সহিংসতা শুরু হওয়ার পর এটিই ছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শাস্তিমূলক বার্তা। তিনি আরো বলেন, এটি বলতে আমাদের দ্বিধা নেই যে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যে আচরণ করেছে তা নৃশংস এবং একটি দেশের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ‘জাতিগত নিধনের’ অভিযান। নিকি হ্যালির এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটন জাতিসঙ্ঘে প্রথমবারের মতো রাখাইন প্রদেশে চলমান ‘জাতিগত নিধনের’ আওয়াজটি উত্থাপন করল। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে আবশ্যিকভাবে মানবাধিকারকে এবং মৌলিক স্বাধীনতাকে সম্মান দেখাতে হবে। সেনাবাহিনীর মধ্যে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে অতি শিগগিরই তাদের কমান্ড লাইন থেকে সরাতে হবে এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ইউ থাং তুন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মিয়ানমারে কোনো ধরনের ‘জাতিগত নিধন’ কিংবা গণহত্যা চলছে না। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার পেছনে তিনি আরাকান সলিডারিটি আর্মিকে দায়ী করেন। তিনি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবকে মিয়ানমার সফরের আমন্ত্রণ জানান। তবে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে মিয়ানমার সরকারের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নেয় ভেটো ক্ষমতার অধিকারি দুই দেশ চীন ও রাশিয়া। এ সময় চীনের রাষ্ট্রদূত লিয়াং বলেন, আমরা মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সহিংসতার নিন্দা জানাই পাশাপাশি পরিস্থিতি মোকাবেলায় মিয়ানমার সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করি। সঙ্কট সমাধানে আলোচনাকে প্রাধান্য দেয়ার এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সংলাপের আয়োজন করার জন্য তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান। এ জন্য চীন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে সহায়তা করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান তিনি। অপর দিকে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত মিয়ানমার সঙ্কটের নতুন দিক তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, মিয়ানমার থেকে হিন্দু সম্প্রদায়কে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করেছে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালানোর জন্যও তিনি আরসাকে দায়ী করেন। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক কোনো ব্যবস্থা সঙ্কটের সমাধান করবে না বলেও মনে করেন তিনি। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেন জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বাংলাদেশ সীমান্তে যে মানবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার বিবরণ তুলে ধরেন। সঙ্কট সমাধানে তিনি বিশ্বের সহযোগিতা কামনা করেন। নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দীর্ঘ আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত চীন, রাশিয়া ও জাপান মিয়ানমার সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়।