জনগণকে বিষ খাওয়ানোর ফর্মুলা হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়া

0
3840

ডা. মো. বেলায়েত হোসেন
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞান সদৃশ ওষুধনির্ভর। এই ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসকগণ রোগীর চিকিৎসা করেন। এক্ষেত্রে হোমিও ওষুধ তৈরির  জন্য  ফার্মাকোপিয়া অপরিহার্য। হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়া হতে হবে  মহাত্মা হানেমান নির্দেশিত পদ্ধতি অনুসরণে।বাংলাদেশ  হোমিওপ্যাথিক  বোর্ড প্রনীত ফার্মাকোপিয়ায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের নিয়ম-নীতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এই ফার্মাকোপিয়ার বিভিন্ন  জটিলতা তুলে ধরা হয়েছে  এই নিবন্ধে। হোমিও ওষুধ প্রস্তুতের ফর্মূলা সম্বলিত ৯১৩ পৃষ্ঠার পুস্তকটি প্রকাশিত হয়েছে সবুজ কভারে । বইটির শিরোনাম ‘বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়া, প্রথম খন্ড। এ বইটির সূচনাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এটি ‘দি বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিশনার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩’ এর ১৩ (পি) বিধান মোতাবেক প্রস্তুতকৃত এবং অত্র অর্ডিন্যান্স-এর ৩৫-বিধান মোতাবেক বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ও বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলাদেশ  হোমিওপ্যাথিক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত’।
দি বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিশনার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ এর ১৩ (পি) তে হোমিওপ্যাথিক নিয়ম-নীতির ভিত্তিতে এই ফার্মাকোপিয়া প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়ার মুখবন্ধে একক ওষুধের পাশাপাশি সংমিশ্রণ পদ্ধতির হোমিও ওষুধ দিয়ে সারা বিশ্বে সফলভাবে আর্তমানবতার সেবা (!) প্রদানের অদ্ভূত দাবি করা হয়েছে। হোমিওপ্যাথিক নিয়ম-নীতি হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়া প্রণয়নের ভিত্তি বলে স্বীকার করা হলে কোনোক্রমেই হোমিওনীতির মূল পাঁচটি বৈশিষ্ট্য-  সদৃশ ; একক ;  সূক্ষ্ম ;  শক্তিকৃত এবং সুস্থ শরীরে পরীক্ষিত হবার বিকল্প নেই। এ বৈশিষ্ট্যের যেকোনো একটি অমান্য করলে হোমিওপ্যাথি দাবি করা র সুয়োগ নেই।
বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়া প্রণয়নের নিয়ম-নীতির মূল ভিত্তি এর ৪Ñ৬ পৃষ্ঠায় ‘বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়াতে ওষুধ অন্তর্ভুক্তিকরণের যোগ্যতা নিরূপণের মানদ-মালা’ শীর্ষক অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে। তারই ভিত্তিতে ফার্মাকোপিয়া গ্রন্থটি প্রণয়ন করা হয়েছে। উল্লিখিত মানদ-মালার প্রস্তাবনায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক ভিত্তি, বিজ্ঞানী ডা. হানেমান হোমিওপ্যাথির তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিকভাবে প্রণালীবদ্ধ করেছেন মর্মে উল্লেখ এবং ‘অতি প্রাচীনকাল থেকে প্রাচীনকালে লিখিত চিকিৎসাভিত্তিক প্রবন্ধসমূহের উল্লেখযোগ্য অবদান।’ এ কথা স্বীকার করলেও ডা. হানেমানের ‘দি অর্গানন অব মেডিসিন’  নামক আইন গ্রন্থের নাম কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। বিশ্বে ডা. হানেমানের ‘দি অর্গানন অব মেডিসিন’ই হোমিওপ্যাথিক বিষয়ের একমাত্র নীতি নির্ধারণী গ্রন্থ। বিশেষত হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়া প্রণয়নের নীতিমালা সংক্রান্ত দিক নির্দেশনা অর্গাননের ২৬৬Ñ২৭০ অনুচ্ছেদে সুনির্দিষ্টভাবে রয়েছে।
প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে একদিকে হোমিওপ্যাথিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগত ভিত্তি অপরিবর্তিত রয়েছে বলে স্বীকার করা হলেও ৩য় অনুচ্ছেদে রোগের বিবর্তন এবং চিকিৎসাতেও পদ্ধতিগত বিবর্তন আসতে থাকবে বলে দাবি করা হয়েছে। প্রস্তাবনার ৪র্থ অনুচ্ছেদে ‘হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায়  ঐতিহ্যগতভাবে গৃহীত হোমিও-নীতি অবশ্যই হোমিও চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনুসৃত’ হবার কথা বলা হলেও হোমিওপ্যাথিক বৈজ্ঞানিক বিবর্তনের অজুহাত তুলে (ক) সদৃশবিধান-এর সূত্র, (খ) ঐতিহ্যবাহী হোমিও প্রুভিং , (গ) আরোগ্যের লক্ষণসমূহ, (ঘ) বিষবিদ্যা সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত , (ঙ) হেরিং-এর আরোগ্য নির্দেশ ’ সংক্রান্ত নীতি ও প্রাচীন মতবাদের মধ্যে হোমিও চিকিৎসা আজ  সীমাবদ্ধ থাকবে না বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু এটি ধ্রুব সত্য যে, সদৃশবিধান সূত্র, সুস্থ শরীরে ওষুধ পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে  শরীরে বিকশিত লক্ষণসমূহ , রোগীর প্রাকৃতিক রোগ লক্ষণসমূহ  যা আরোগ্যকর, বিষবিদ্যা সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত এবং হেরিং-এর আরোগ্য নীতি এ সব কিছুই প্রাকৃতিকভাবে সংঘটিত হয়। এস পুরোপুরি প্রাকৃতিক নিয়মনীতিতে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত। মানবসৃষ্ট কৃত্রিম কোনো ব্যাপার নয়। যেসব বিষয় শ্বাশত ও চিরন্তন এবং প্রাকৃতিকভাবে সংঘটিত তাকে ‘প্রাচীন মতবাদ’ বললে নিতান্তই ভুল করা হবে। অথচ এক্ষেত্রে সেই ভুল করা হয়েছে। সে অজুহাতে ফার্মাকোপিয়া ওষুধের প্রস্তুত ফর্মূলা ‘উল্লিখিত নীতি ও প্রাচীন মতবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়’ বলে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে।
‘বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়া’তে ওষুধ অন্তর্ভূক্তিকরণের শর্ত নিরূপণের মানদন্ডমালা’-এর ১ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আমেরিকা, ভারত, ইউরোপসহ ছয়টি দেশের ফার্মাকোপিয়া, এম. ভট্টাচার্যের হোমিও ফার্মাকোপিয়া এবং কয়েকজন বিদেশি লেখকের লেখা কয়েকটি বায়োকেমিক পুস্তককে অত্র ফার্মাকোপিয়া কমিটি স্বীকৃিত প্রদান করেছে। সেসব ফার্মাকোপিয়ার স্বীকৃতি মোতাবেক ‘সকল একক হোমিও ওষুধের এবং সংমিশ্রিত হোমিও ওষুধের ফর্মূলাসমূহকে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়ায় অন্তর্ভূক্ত করা হলো যার বর্ণনা ওষুধ পরিচিত এবং ফর্মূলাসমূহ  ধারবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে।’
হোমিওপ্যাথির সবকিছু ডা. হানেমানের অর্গানন অব মেডিসিনের বিধি বিধানে নিয়ন্ত্রিত। বলাবাহুল্য, হোমিও ফার্মাকোপিয়াই হোক আর অন্য কোনো হোমিও পুস্তকই হোক –  হোমিওপ্যাথি সংশ্লিষ্ট কোনো  পুস্তকই অর্গানন অব মেডিসিনে বর্ণিত নিয়মের বাইরে প্রণয়নের সুযোগ নেই। অর্গানন অব মেডিসিনের কোথাও সংমিশ্রণ ওষুধ ব্যবহারের বৈধতা দেয়া হয়নি। এ আইন গ্রন্থের ২৭৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “চিকিৎসার কোনো ক্ষেত্রেই একই সময় একাধিক অবিমিশ্র ভেষজ প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না । এ কারনেই তা সমর্থনযোগ্য নয়। একমাত্র  প্রাকৃতিক আরোগ্যকলা হোমিওপ্যাথিক বিধানে রোগীকে একই সময় বিভিন্ন প্রকারের একাধিক ভেষজ দ্রব্য প্রয়োগ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।” সেখানে কীভাবে সংমিশ্রণে প্রস্তুতির ফর্মূলাসম্বলিত ফার্মাকোপিয়া বৈধতা পেতে পারে! সংমিশ্রণের স্বীকৃতি যেহেতু অর্গাননে মেলে না, সেজন্যই খুব সচেতনতার সাথে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়ার ওষুধ প্রস্তুতির মানদ-মালার রেফারেন্স পুস্তকের তালিকায় ডা. স্যামুয়েল হানেমানের অর্গানন অব মেডিসিন পুস্তকের নাম বাদ দেয়া হয়েছে! ফার্মাকোপিয়া বা অন্য কোনো গ্রন্থে সংমিশ্রণ ওষুধ প্রস্তুতের ফর্মূলাসংযুক্ত করা হলেও কোনোক্রমেই হোমিওফার্মাকোপিয়া প্রস্তুতের রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা অর্গাননের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমেরিকা,ইউরোপ কিংবা অন্য  বিদেশী ফার্মাকোপিয়ার দোহাই দিয়ে হোমিওপ্যাথিতে তা অন্তর্ভুক্তির সুযোগ নেই।
মানব-মালার  চার নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত কতিপয় সংমিশ্যিত ওষুধের ফর্মূলা প্রাথমিক পর্যায়ে অত্র ফার্মাকোপিয়া কমিটি কর্তৃক গৃহীত ও অন্তর্ভূক্ত করা হল।” সংমিশ্রণ বা মিশ্রণ ওষুধ হোমিওপ্যাথি ওষুধ নয়। হোমিওপ্যাথি ওষুধের মর্যাদা লাভের প্রশ্নই আসে না। ক্ষতিকর বলেই ডা. হানেমান এসব শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি; অধিকন্তু হোমিওপ্যাথির সাথে মিশ্রণ ওষুধ ব্যবহারকারীদের শঙ্কর, উভলিঙ্গ,অর্বাচিন এবং জারজ মন্তব্য করেছেন।
মানদ-মালার পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘ক্লিনিক্যাল প্রুভিং এর মাধ্যমে ঔষধের রোগ নিরাময় উপশমকারী ব্যবহার বা কার্যকরিতা প্রতিষ্ঠিত হলে ফার্মাকোপিয়া কমিটির নিকট গ্রহণযোগ্য হবে।’- বলে মন্তব্য করা হয়েছে। সুস্থ শরীরে ওষুধ প্রুভিং পদ্ধতি প্রবর্তনের পর ক্লিনিক্যাল প্রুভিংকৃত ওষুধ হোমিওপ্যাথিতে গ্রহণযোগ্যতা লাভের প্রশ্নই আসে না। কারণ ক্লিনিক্যাল প্রুভিং করা হয় রোগীর উপর। সেক্ষেত্রে ওষুধের লক্ষণ ও রোগীর লক্ষণ মিলে মিশে এককার হয়ে যায়। সুস্থ শরীরে পরীক্ষা করা ছাড়া ওষুধের বিশুদ্ধ ক্রিয়া জানার  সুযোগ নেই। অর্গানন অব মেডিসিনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সুস্থ ব্যক্তির স্বাস্থ্যের  বিকৃতি ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে ভেষজের আরোগ্যকারী ক্ষমতা জানা সম্ভব নয় (অর্গানন অনুচ্ছেদ : ২০, ২১ এবং পাদটীকা: ১৬৫)। হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়া প্রণয়নের ক্ষেত্রে মনগড়া নিয়ম-নীতি প্রবর্তনের চেষ্টা চিকিৎসক সমাজে অগ্রহনযোগ্য এবং প্রথাক্ষ্যাত।
মানদ-মালার ছয় নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘ভেষজ অথবা ওষুধের সক্রিয় উপাদান বা উপাদানসমূহ যা রোগ নিরাময়কারী, উপশমকারী ওষুধ বা ভেষজ হিসেবে গ্রন্থে উল্লেখ আছে। তাতে অবশ্যই লক্ষণ চিত্র বাস্তব লক্ষণ এবং বিশদ লক্ষণাদি উল্লেখ থাকবে। ওষুধের এ ধরনের লক্ষণভিত্তিক ব্যবহার ও চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থ বা দলিলাদি শুধু স্যামুয়েল হানেমান; সি. হেরিং; টি.এফ.এলেন; এইচ.সি. এলেন; জে.এইচ. ক্লার্ক; জে.টি. কেন্ট; ডব্লিউ কেরী; উইলিয়াম বরিক এর লেখার উপর সীমাবদ্ধ থাকবে না।’ এটি ফার্মাকোপিয়া প্রণয়ন কমিটির একটি সিদ্ধান্ত। উপরে বর্ণিত চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা সুস্থ শরীরে পরীক্ষিত ওষুধের লক্ষণচিত্র সম্বলিত যেসব মেটারিয়া মেডিকা পুস্তকাদি তৈরি করেছেন সেগুলোই এ যাবত দালিলিক হোমিওপ্যাথিক লক্ষণ বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃত। অত্র ফার্মাকোপিয়া প্রণয়ন কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক সুস্থ শরীরে পরীক্ষিত ওষুধসমূহ নিয়ে প্রণীত সব মেটিরিয়া মেডিকা ছাড়াও হোমিওপ্যাথির নামে যত অপরীক্ষিত এবং মিশ্রণ ওষুধ নিয়ে লিখিত গ্রন্থ হোমিওপ্যাথিক লক্ষণ বিজ্ঞান হিসেবে ব্যবহারে কোনো বাধা থাকবে না। এমন বিধান  হলে হোমিওপ্যাথিক গ্রন্থ এবং অপরীক্ষিত, মিশ্র ও বায়োকেমিক ওষুধ নিয়ে  তৈরি গ্রন্থ মিলে মিশে সব একাকার হয়ে যাবে। প্রকৃত হোমিওপ্যাথি হারিয়ে যাবে নামধারী নকল হোমিওপ্যাথির অন্ধকার গহ্বরে।
অত্র মানদ-মালার শেষ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘উল্লিখিত নীতিমালাসমূহের আওতায় বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়ার প্রথম খন্ডে অন্তর্ভূক্ত একক ও সংমিশ্র ফর্মূলার ওষুধসমূহ গ্যালনিক ফর্মে (স্বীকৃত সকল ডোজেজ ফর্মে) দেশের হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারক, আমদানিকারক, বিক্রেতা ও চিকিৎসকগণ ওষুধ প্রশাসন পরিদপ্তরের অনুমতিক্রমে জেনেরিক ও ট্রেড নামে উৎপাদন, আমদানি, প্রদর্শন, বাজারজাতকরণ, সরবরাহ ও ব্যবহার করতে পারবে।’ সংমিশ্রণ এবং ট্রেড নামে ওষুধ প্রচলন ও ব্যবহারের অনুমতি দিলে  হোমিও ওষুধের একক সত্ত্বা, একক অস্তিত্ব এবং একক বৈশিষ্ট্যেমন্ডিত হওয়ার  অপরিহার্যতা থাকবে না। ফলে স্বতন্ত্র চরিত্রের এক ব্যক্তির জন্য স্বতন্ত্র  একক ওষুধ সদৃশকরণের  বিধান মানার কঠোর নিয়ম  থাকবে না। ফলে হোমিওপ্যাথি অস্তিত্ব সংকটে পড়তে বাধ্য। তাছাড়া ট্রেড নামে হোমিও ওষুধ প্রচলিত হলে অন্য চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে হোমিওপ্যাথির  পার্থক্য থাকবে না। হোমিওপ্যাথি ধ্বংসের জন্য ট্রেড নামে ওষধু প্রচলনই যথেষ্ট।
বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়াতে ওষুধ অন্তভূক্তিকরণের যোগ্যতা নিরূপনের মানদন্ডমালায় অর্গানন অব মেডিসিনে বর্ণিত নিয়ম লঙ্ঘন করে  নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে ।এর আওতায় জায়েজ করা হয়েছে নিষিদ্ধ ওষুধ তৈরি ও ব্যবহারের অনুমোদন।এর মধ্যে অন্যতম হলো মলম ও মালিশ জাতীয় বাহ্য প্রয়োগের ওষুধ। বাহ্য প্রয়োগের মলম এবং এ জাতীয় বস্তু প্রস্তুতের জন্য কতকগুলো উপাদানকে নিষ্ক্রিয় উপাদান হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। সেসব উপাদানের মধ্যে রয়েছে অলিভ অয়েল, গ্লিসারিন,অ্যালমন্ড তেল, প্যারাফিন বা ভ্যাসিলিন তরল ও নরম, সাদা মোম, স্পারমাসিটি, তিলের তৈল, রোজ মেরি তেল, চর্বি, কাঁচা সাবান, শক্ত সাবান, নরম সাবান, শর্করা, ল্যানোলিন, মৌ-মোম, সহজ মলম, নারকেল তেল এবং জেল। এসব মালিশের মতো ক্ষতিকর নিষিদ্ধ ওষুধ তৈি তে ব্যবহৃত হবার ঝুকি রয়েছে।আসলে হোমিও ওষুধ প্রস্তুতে এর কিছুই লাগে না। মলম তৈরির উপাদানগুলোর প্রত্যেকটিরই প্রাকৃতিক গুণধর্ম রয়েছে।
হোমিওপ্যাথি পুরোপুরি প্রাকৃতিক নিয়ম-নীতিনির্ভর।ওষুধ চিকিৎসাবিজ্ঞানের হাতিয়ার। সেই ওষুধ প্রস্তুত  প্রশ্নে নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন হলে ফার্মাকোপিয়া প্রণেতাদের দায়িত্বশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। বাহ্য প্রয়োগের ওষুধ ব্যবহারের প্রশ্নে ডা. হানেমান তাঁর অর্গানন অব মেডিসিন গ্রন্থের ১৯৪ অনুচ্ছেদে বলেন, “নবাগত একিউট ব্যাধিতেই হোক কিংবা বহুদিন স্থায়ী স্থানীয় ব্যাধিতেই হোক, কোনো বাহ্য ওষুধ, মহৌষধ হলেও এবং সদৃশ লক্ষণ হেতু তা আভ্যন্তরীণ প্রয়োগে ফলপ্রদ হলেও, আক্রান্ত স্থানে বাহ্য প্রয়োগের  আবশ্যকতা নেই।এমনকি একই সময়ে তা আভ্যন্তরীণ প্রয়োগ করা হলেও না। বাহ্য প্রয়োগের আবশ্যক না হওয়ার কারণ হচ্ছে- আঘাতজনিত রোগ ছাড়া সকল ব্যাধির কারণ আভ্যন্তরীণ এবং প্রতিকারও আভ্যন্তরিকভাবেই করতে হবে।”  রোগ নিরাময়ে শক্তিকৃত ওষুধ আভ্যন্তরীণ প্রয়োগের  বিকল্প নেই।
অত্র ফার্মাকোপিয়াতে ওষুধ অন্তর্ভুক্তিকরণের যোগ্যতা নিরূপণের মানদন্ডমালায় ঘোষিত নীতিমালারা  ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ তৈরির ফর্মূলা স্থান পেয়েছে । তার মধ্যে তিনশ একক ওষুধের ফর্মূলা এবং ১৬৮টি সংমিশ্রণ উপাদানের ওষুধের ফর্মূলা আছে। তিনশ একক ওষুধের মধ্যে অল্প কয়েকটি ওষুধ ছাড়া  সবগুলোই অপরীক্ষিত । সেগুলোরই ওষুধের প্রস্তুত ফর্মূলা দেয়া হয়েছে। ওষুধগুলো সবই দশমিক স্কেলের প্রস্তুতি। সদৃশ, যোগ্য, একক, সূক্ষ্ম, পরীক্ষিত ও শক্তিকৃত এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের যেকোনো একটি বাদ গেলে হোমিওপ্যাথি ওষুধ থাকে না। অত্র ফার্মাকোপিয়ায় উল্লিখিত ফর্মূলাগুলোর মধ্য থেকে একটি একক ওষুধের এবং একটি সংমিশ্রণ উপাদানের ফর্মূলা এখানে তুলে ধরছি।
“কার্বো-ভেজিটেবলিশ (ঈধৎনড়-াবমবঃধনরষরং),
সমকালীন নাম: অপঃরাধঃবফ পযধৎপড়ধষ।
ইংরেজি নাম: ঠবমরঃধনষব ঈযধৎপড়ধষ।
বর্ণনা: বিচ কাঠ হতে সবজি অঙ্গার প্রস্তুত করা হয়। অল্প বাতাসে একটি কাঠ  রেখের কিয়দংশ মাটিতে ঢেকে জ্বালিয়ে দিতে হবে। এই কাষ্ঠ হতে প্রাপ্ত কয়লা কালবর্ণের ছিদ্রময় এবং ভঙ্গুর হয়। এর কোনো গন্ধ বা স্বাদ  নেই। জ্বালাবার সময় শিখা  বের হবার দৃশ্য দেখা উচিত নয়। এর গ্যাস শোষণের ক্ষমতা আছে। তেঁতুল কাষ্ঠ হতে প্রাপ্ত অঙ্গারের গ্যাস শোষণক্ষমতাও অত্যধিক।
বিচুর্ণ ঔষধের শক্তি:  ১/১০ বা ওঢ,
প্রস্তুতপ্রণালী: বিচূর্ণ শ্রেণী Ñ এফ,
তরল শক্তিকৃত শ্রেণী Ñ এইচ।
উপাদান    পরিমান
কার্বো-ভেজিটেবিলস    ১০০ গ্রাম
ল্যাকটোজ    ৯০০ গ্রাম
এক হাজার গ্রাম বিচুর্ণ প্রস্তুত হবে।
ওষুধ প্রয়োগ: সরাসরি বিক্রয়যোগ্য (ঙঞঈ) = ওঢ
চিকিৎসকের পরামর্শ (জী) = শক্তির বাধ্যবাধকতা নাই।
ওষুধ প্রস্তুতির জন্য (ঐচঘ) = শক্তির বাধ্য বাধকতা নাই।”
সবগুলো ওষুধই দশমিক স্কেলের প্রস্তুতি। শততমিক এবং পঞ্চাশ সহস্রতমিক স্কেলের প্রস্তুতির ফর্মূলা একটি ওষুধেরও দেখানো হয়নি। যদিও দেশে ব্যাপক সংখ্যক চিকিৎস শততমিক ও পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তির ওষুধ ব্যবহার করেন। ফলে শততমিক ও পঞ্চাশ সহস্রতমিক স্কেলের ওষুধ প্রস্তুতির ফর্মূলা ফার্মাকোপিয়াতে না থাকায় দেশের ব্যাপক সংখ্যক চিকিৎসকের কাছে এর তেমন  গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। ওষুধের প্রয়োগের ক্ষেত্রে ওঢ সরাসরি বিক্রয়যোগ্য। চিকিৎসকের পরামর্শ এবং ওষুধপ্রস্তুতের জন্য শক্তির কোনো বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি।
বলাবাহুল্য, কার্বোভেজসহ যেকোনো ওষুধ  হোমিওপ্যাথি ওষুধের গুণধর্মে উন্নীত করতে হলে অবশ্যই যথাযথ শক্তিকৃত হতে হবে (অর্গানন অব মেডিসিন, অনুচ্ছেদ: ২৪৬-২৪৮)। যথাযথ শক্তিকৃত ওষুধ ব্যতীত কোনো ওষুধই হোমিওপ্যাথি ওষুধ হিসেবে বিক্রয় এবং চিকিৎসকের পরামর্শ দেয়ার অনুমতি পেতে পারে না। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি ওষুধ স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটানোর ক্ষমতা আছে বলেই তা সুস্থতা বিধানের ক্ষমতা রাখে। ওষুধ প্রয়োগ ও বিক্রির ক্ষেত্রে যথাক্রমে চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টদের মাধ্যমে হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকা জরুরি।
একটি সংমিশ্রণ উপাদনের ওষুধের ফর্মূলা তুলে ধরছিÑ
“শ্বাস-প্রশ্বাস সংক্রান্ত হাঁপানিনাশক, ব্রংকাইটিস লক্ষণের সংমিশ্রণ ঔষধের ফর্মূলা।
ফমূর্লা ৬।   ফর্ম : তরল (সিরাপ)
(ক) সক্রিয় উপাদান প্রতি ১০০ মিলিলিটারে পরিমাণ
একোনাইট ন্যাপ     ৩ী    ৫ মিলি:
ব্রায়োনিয়া     ৩ী    ১০ মিলি:
হিপার সালফ ক্যাল     ৬ী    ১০ মিলি:
স্পঞ্জিয়া     ৩ী    ১০ মিলি:
স্টেনাম- মেট    ৬ী    ৫   মিলি:
প্রয়োজনীয় পরিমাণ সহযোগী উপাদানসহ ১০০ মিলি: করতে হবে। এলকোহলের পরিমাণ ৯৫% (া/া)।
(খ) সহযোগী উপাদান : এনেক্সার – ২
(গ) প্রস্তুত প্রণালী : এনেক্সার – ৫
(ঘ) কার্যকারিতা : ঠান্ডার কারণে গলায় এবং শ্বাসনালীর ঝিল্লিতে সামান্য উত্তেজনায় উৎপন্ন কাশিকে সাময়িকভাবে উপশম দেয়। গলা প্রশমিত করে। ব্রংকিয়াল থেকে চটচটে বিরক্তকর শ্লেম্মা হতে মুক্ত এবং ব্রংকিয়াল পরিষ্কারের জন্য ব্রংকিয়াল থেকে পাতলা শ্লেষ্মা নিঃসরণ হতে সাহায্য করে।
(ঙ) ডোজ ও সেবন বিধি: প্রাপ্তবয়স্ক ২ চা চামচ, অপ্রাপ্তবয়স্ক ১-১.৫০ চা চামচ, শিশু ১/১.৫০ চা চামচ করে ২ ঘন্টা পর পর। মারাত্মক কাশির জন্য প্রথম ঘণ্টায় ২০ মিনিট পরপর দেয়া যেতে পারে অথবা রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেব্য।
(চ) রেফারেন্স: আমেরিকান হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়া এবং ভারতীয় হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়া ।
ক্লিনিক্যাল প্রুভ: আমেরিকার বোরিক এবং টোফেল কোম্পানির প্রস্তুতকৃত হোমিওপ্যাথি ওষুধ এবং ব্রংকিয়াল সিরাপ উপরোক্ত ফর্মূলার সাথে সমসাদৃশ্যপূর্ণ এবং ঔষধ প্রশাসন পরিদপ্তর গঠিত কমিটি কর্তৃক নির্বাচিত বিশেষজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকবৃন্দ দ্বারা ক্লিনিক্যালি প্রুভ।”
সংমিশ্রণ ওষুধ বলে হোমিওপ্যাথিতে কিছুই নেই।এই ধরনের ফর্মুলা হোমিওপ্যাথিক নিয়ম-নীতির বিরোধী। এখানে বর্ণিত ৬ নং ফর্মূলাতে সংমিশ্রণ তৈরির জন্য  পাঁচটি ওষুধের উল্লেখ করা হয়েছে ।এর সবগুলোই হোমিওপ্যাথিক নিয়মে পরীক্ষিত। সব আদর্শ হোমিওপ্যাথিক মেটারিয়া মেডিকাতে এসব ওষুধের মানসিক এবং শারীরিক সামগ্রিক লক্ষণসহ সব ধরনের লক্ষণের পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়। যেসব ওষুধ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লক্ষণ নিয়ে বিকশিত হয়ে স্বতন্ত্র পরিচিতিতে  মহিমাম্বিত – এরা প্রত্যেকে এককভাবে দক্ষ চিকিৎকের হাতে ব্যবহৃত হয়ে ডা. হানেমানের সময় থেকে আজ পর্যন্ত কত রোগী যে ঠান্ডা লাগা, কাশি, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি নামধারী রোগসহ কত তরুণ কঠিন ও জটিল নানা অসুস্থতা থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি পেয়েছে এবং পাচ্ছেন তার কোনো সংখ্যাগত হিসাবে  নেই। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগের শর্ত হচ্ছে Ñ সদৃশ, একক, শক্তিকৃত ও সূক্ষ্ম মাত্রা। সংমিশ্রিত ওষুধের স্থান নেই হোমিওপ্যাথিতে ।সেখানে পরীক্ষিত একক ওষুধের সংমিশ্রণ – এ যেন আদর্শ হোমিও ওষুধের  চরিত্র হননের অবাঞ্ছিত প্রয়াস।
ডা. হানেমান তার অর্গানন অব মেডিসিনের ২৭৪ অনুচ্ছেদে বলেন, “একক ও অযুক্তভাবে প্রয়োগ করা হলে প্রকৃত চিকিৎসক  অবিমিশ্য ভেষজের মধ্যে বাঞ্ছনীয় সব কিছুই পেতে পারেন তখন সরল উপায়ে যথেষ্ট হলে জটিল উপায়ে প্রয়োগ করা ভুল এই নীতিবাক্য স্মরণ রেখে আর কিছু দিবার কথা চিন্তা করবেন না। আর এসব কারণে যে অমিশ্র ভেষজসমূহ সুস্থ মানব শরীরে তাদের বিশুদ্ধ ক্রিয়া সম্বন্ধে সম্পূর্ণ পরীক্ষিত হয়ে থাকলেও দু বা ততোধিক ভেষজ দ্রব্য সংযুক্ত হলে মানবশরীরে পরস্পরের ক্রিয়া কীভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং পরিবর্তিত হয় তা পূর্ব হতে জানা অসম্ভব।” সংমিশ্রণের প্রয়োজনীয়তা এবং অপকারিতা সম্পর্কে মহাত্মা ডা. হানেমানের নির্দেশই যথেষ্ট।
তাই এই ফার্মোকোপিয়ায় উল্লিখিত নীতিমালা, সংমিশ্রণের ফর্মূলা, অপরীক্ষিত ও অশক্তিকৃত ওষুধের ফর্মূলা এবং সেসবের উৎপাদন, বিক্রয়, বাজারজাতকরণ ও প্রয়োগের প্রেসক্রিপশন দেয়ার অনুমতি সম্বলিত ফার্মাকোপিয়া প্রণয়ন ও প্রকাশ প্রচলিত বিদ্যমান আইন, বিধান ও নিয়ম-নীতির পরিপন্থী।
(১)    ডা.হানেমানের অর্গানন অব মেডিসিনে উল্লিখিত বিধিবিধান হোমিওপ্যাথিক ফার্মোকোপিয়ার বিষয়বস্তুর সীমারেখা ও আওতা সংরক্ষিত।
(২)    (দি বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিশনাল অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ এর ১৩ (পি) ধারায় বলা হয়েছে। “ (চ) ঞড় চৎবঢ়ধৎব ইধহমষধফবংয ঐড়সড়বড়ঢ়ধঃরপ চযধৎসঁপড়ঢ়বরধ ড়হ ঃযব নধংরং ড়ভ চৎরহপরঢ়ষব ড়ভ ঐড়সড়বড়ঢ়ধঃযু”। অত্র অর্ডিন্যান্সের ২ (ডি) তে হোমিওপ্যাথি বলতে ডা.স্যামুয়েল হানেমানের প্রতিষ্ঠিত হোমিওপ্যাথিকে বুঝায়। সর্বোপরি, ‘হোমিওপ্যাথি’ শব্দটি স্বব্যাখ্যাত।  এর অর্থ ‘সদৃশ রোগ’।
সুস্থ শরীরে যথাযথভাবে পরীক্ষিত একক ওষুধের চারিত্রিক ও প্রকৃতিগত লক্ষণাবলী কোনো রোগীর চারিত্রিক ও প্রকৃতিগত লক্ষনাবলীর সাথে সদৃশভবিতাসম্পন্ন হয়ে ডা. হেরিং এর আরোগ্য নীতি  মোতাবেক আরোগ্যক্রিয়া সম্পন্ন হলে তাকে হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য বলা হয়। ডা. টি.এফ. এলেন তাঁর দি এনসাইক্লোপিডিয়া অব পিউর মেটিরিয়া মেডিকাতে বলেনÑ “হোমিওপ্যাথি সদৃশবিধানভিত্তিক একটা নিয়ম-নীতিসম্মত চিকিৎসা পদ্ধতি।”
ডা. হানেমান বলেন, “শান্তভাবে প্রকৃত আরোগ্যলাভ কেবলমাত্র হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতিতেই সম্ভব। কারণ এই আরোগ্যকলা প্রকৃতির চিরন্তন অভ্রান্ত নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত” (অর্গানন অনুচ্ছেদ: ৫৩)। এই প্রসঙ্গে বলছি, একে ‘প্রাচীন মতবাদ’ বলা নিতান্তই ভুল। এটি কতকগুলো নিয়মনীতির সীমারেখায় পরিবেষ্টিত একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। হোমিওপ্যাথির বাইরে কোনো হোমিওপ্যাথি নেই। ডা. হানেমান বলেন, “দুটি বিন্দুর মধ্যে একটির বেশি সরলরেখা টানা যেমন অসম্ভব, হোমিওপ্যাথি ছাড়া প্রাকৃতিক রোগ (যে সকল ব্যাধি ঠিক সার্জিক্যাল নয়) আরোগ্যের আর কোনো প্রকৃত ও সর্বোত্তম পদ্ধতিও তেমনি অসম্ভব।”
স্মরণযোগ্য যে, অসৃদশ, অপরীক্ষিত, অশক্তিকৃত অনুমান নির্ভর ওষুধ ব্যবস্থাকে – যা কিছুকে অপকারী এবং ক্ষতিকর জেনেই ডা. হানেমান পরিত্যাগ করে প্রধান মেডিক্যাল অফিসারের চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলেন। সত্যিকার চিকিৎসাবিজ্ঞানের সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত রেখে অনেক গবেষণার পর হোমিওপ্যাথি আবিষ্কার করেন। এখন সেই পরিত্যজ্য ওষুধ ব্যবস্থা এবং হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতিকে  একাকার হয়ে যেতে দেয়া যায় না। কারণ, একটি অন্যটির বিপরীত। (অর্গা:, অনু: ৫২)। মন্দের প্রাধান্য ভালোকে বিতাড়িত করে। দূষিত পানি এবং বিশুদ্ধ পানি একই স্রোতধারায় চলতে দিলে বিশুদ্ধ পানির বিশুদ্ধতা দূষিত পানির মধ্যে হারিয়ে যায়। প্রাকৃতিক শাশ্বত রোগারোগ্যের একমাত্র সদৃশ সূত্রের বিশুদ্ধতাকে অসদৃশ এবং সংমিশ্রিত মনগড়া ওষুধ ব্যবস্থার সাথে একত্রে চলতে দিলে প্রথমোক্তটি শেষোক্তটির মধ্যে হারিয়ে যাবে। এ সাধারণ নিয়মের  ব্যতিক্রম নেই। অবশ্য বর্তমানে সারা দেশে এবং সারা বিশ্ব হোমিওপ্যাথির নামে অহোমিওপ্যাথি ওষুধ ব্যাপকভাবে চালু আছে। এই সুযোগে যারা ব্যবসায়িক স্বার্থে ট্রেড নাম এবং সংমিশ্যণ ওষুধ বস্তু হোমিওপ্যাথির সাথে মিলিয়ে চালু রাখতে চান তাদের জানা উচিত এসব কিছুর মধ্যে রুগ্ন মানুষের জন্য মহা অকল্যাণ ছাড়া কিছু নেই। ডা. হানেমান বলেন, ‘যিনি হোমিওপ্যাথি এবং অ্যালোপ্যাথি – একটাও জানেন না তারমতো মুর্খের পক্ষেই এই ধারণা  থাকা  সম্ভব যে, দুটি পদ্ধতি মিলিত হয়ে পরস্পরের সাথে যুক্ত হতে পারে। তিনি রোগীর ইচ্ছা অনুসারে একসময় হোমিওপ্যাথি এবং অন্য সময় এলোপ্যাথির মতো চিকিৎসা করে নিজেকে হাস্যস্পদ করেন। এইরূপ চিকিৎসা  হোমিওপ্যাথির সাথে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধ বলা যেতে পারে” (অর্গা: অনু : ৫২)।
বাংলাদেশে অর্ধশতাব্দী ধরে অর্গানন অব মেডিসিন-এর নিয়ম-নীতিভিত্তিক হোমিওপ্যাথির স্বীকৃতি রয়েছে। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ‘দি ইউনানী, আয়ুর্বেদী এন্ড হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিশনার্স এ্যাক্ট ১৯৬৫ জারি করে। সে এ্যাক্টের বলে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের নামে প্রতারণা এবং মাদক চোরাকারবারি রোধে সরকার ১৯৭৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মি¯্র ওষুধ পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষনা করে (স্মারক নং এফ ২১ (এন) ৭৪.৩৭০১)। ওষুধ প্রশাসন পরিদপ্তর ১৯৮৪ সালের ৯ জানুয়ারি এবং ২৩ এপ্রিল এ সম্পর্কিত আরো দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে এ ব্যাপারে দাপ্তরিক প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয় একশ্রেণির ওষুধ চোরাকারবারিদের সঙ্গে গোপন আতাত করে।নিষিদ্ধ ওষুধের তালিকা সংবাদপত্রে প্রকাশ না করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ওষুধ প্রশাসনে তালিকা সংরক্ষিত থাকবে। আগ্রহীরা তা দেখতে পারবেন। মজার ব্যাপার নিষিদ্ধ ওষুধের তালিকা গেজেটে প্রকাশ না করে  অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গোপন আতাত করে দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে  ভোক্তা এবং সংশ্লিষ্ট মহলের আড়ালে রাখতে সক্ষম হয়েছে কড়িৎকর্মা প্রশাসন।তারাই এখন ফার্মাকোপিয়া আড়ালে রেখে অবৈধ বাণিজ্যে মেতে উঠার ধান্ধায় মশগুল আছেন।
হোমিওপ্যাথিক বোর্ড প্রনীত বিতর্কিত ফার্মাকোপিয়া সংশোধন এবং অবৈধ প্যাটেন্ট টনিক উৎপাদন এবং বাজারজাতের বিরুদ্ধে মামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা অপহিায হয়ে উঠেছে। ৩২ বছর আগে নিষিদ্ধ  ঘোষিত ৭৮০ টি মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ  ওষুধ ব্যবহার এবং বাজারজাত  বন্ধে আজো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ‘সাপ্তাহিক ২০০০’ পত্রিকায়, ১৩ অক্টোবর-২০০২  হোমিওপ্যাথির নামে ৭৮০টি নিষিদ্ধ ওষুধ বাজারে’ এবং সাপ্তাহিক ‘প্রতিচিত্র’ পত্রিকা ৩ মে ২০০২ ‘ওষুধের নামে বিষ’ শীর্ষক আমার লেখা প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তখন ব্যাপক  হৈচৈ পড়ে যায় চিকিৎসক সমাজে। হোমিওপ্যাথির নামে অহোমিওপ্যাথি এবং সংমিশ্রিত ওষুধ বস্তু (পেটেন্ট, টনিক, মলম, মিশ্রণ, মাদার টিংচার, বায়োকেমিক একসাথে চলতে পারে না- তা আমি সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছিলাম।। হোমিওপ্যাথি মানেই ডা. স্যামুয়েল হানেমানের ‘দি অর্গানন অব মেডিসিন’। এর বাইরে হোমিওপ্যাথির কোনো স্থান নেই।
অর্গানন অব মেডিসিন প্রথম সংস্করণের ভূমিকায়হ্যানেমান  বলেছেন “আমার বিশ্বাসের ফসলসমূহ এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এখন চিকিৎসক সমাজ যারা আন্তরিকতা ও সততার সাথে তাঁদের সমধর্মীদের জন্য কাজ করতে ইচ্ছা করেন, তাঁরা অনুমানমূলক ও খামখেয়ালিপনার ক্ষতিকর পদ্ধতিতে লেগে থাকবেন; না হিতকারী সত্যের পথ অবলম্বন করবেন- তা লক্ষ করার অপেক্ষায় রইলাম।” বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার এই অপেক্ষা তাৎপর্যমন্ডিত। কেননা প্যাটেন্ট, টনিক এবং মিশ্র ওষুধ প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বসে নেই।ভারতীয় বি জৈন ফার্মাসিউটিক্যালস প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির সঙ্গে গত ১৫ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশী আমদানিকারক এক্সিমপো চুক্তিপত্র সম্পাদন এবং ওষুধ প্রদর্শনর আয়োজন করে।অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডা. আব্দুল করিম। এর পর তিনি বাংলাদেশ হোমিও পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির পদ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিক্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ হোমিও পরিষদ এত দিন দেশের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক এবং রোগীদের স্বার্থসংরক্ষণে বলিষ্ঠ ও উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে অসছিল।পরিষদ সভাপতি ডা. আব্দুল করিম বাংলাদেশী আমদানিকারক এক্সিমপোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা.সালেহ আহমেদ সুলেমান তার জামাতা। হোমিওপ্যাথির আবিস্কারক ডা. মহাত্মা স্যামুয়েল হ্যানিমান প্রণীত অর্গানন অফ মেডিসিন বহির্ভুত বাণিজ্যিক নামের প্যাটেন্ট, টনিক, কম্পাউন্ড এবং বাহ্য প্রয়োগের ওষুধ আমদানি, প্রদর্শন, বিক্রি এবং বিতরণ  অবৈধ বলে তিনি মন্বব্য করেছেন।
রাজধানীর ইঞ্জনিয়র্ািস ইনস্টটিউিশন মিলনায়তনে গত ২৭ মে বাংলাদশ হোমিওপ্যাথিক পরিষদের জাতীয় কনভনেশনে হোমিও সংরক্ষণ কমিটির আহবায়ক ডা. গোলাম মোস্তফা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ক্ষেত্রে হ্যানিমানের নীতি-আদর্শ অনুস্মরণের ওপর গুরুত্বারোপ করে হোমিওবোর্ড প্রনীত ফার্মাকোপিয়াকে অবৈধ মাদক ও স্পিরিট চোরাকারবারিদের গোপন দলিল উল্লেখ করে অবিলম্বে তা বাতিলের জন্য সরকারের প্রতি জোর আহবান জানান।  কনভনেশনরে আহ্বায়ক ডা. এ  কে এম শহীদ উল্লাহসহ  অংশগ্রহনকারী বিশিষ্ট চিকিৎসকগণ  এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষনা করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম প্রধান অতিথির বক্তব্যে দ্যর্থহীন ভাষায় অবৈধ ওষুধ এবং ভুয়া চিকিৎসকদের সমুলে উচ্ছেদের ঘোষনা দেন। বাংলাদশে  হোমিওপ্যাথি  বোর্ডের  চেয়ারম্যান ডা. দিলীপ কুমার রায় বিতর্কিত ফার্মাকোপিয়া সংশোধন এবং অবৈধ প্যাটেন্ট টনিক বাজারজাত নিষিদ্ধের ঘোষণা  দেন। তবে  এই ঘোষণা বাস্তবায়নের ব্যাপারে সন্ধিহান দেশের চিকিৎসক সমাজ। এ জন্য তাদের অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে হবে।
যোগাযোগ প্রয়োজনে
বেলায়েত হোসেন
এম.এ, ডি.এইচ.এম.এস.
০১৭৯৫০৭৫৫৫৬
ই-মেইল: নযড়ংংধরহনফ@মসধরষ.পড়স

Advertisement
Advertisement

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here