দেশের ২০ শতাংশ অভিভাবকই জানেন না যে তাঁদের সন্তান চোখের সমস্যায় ভুগছে। আবার অনেকে জেনেও সময়মতো চিকিৎসা না করানোর ফলে বড় একটি অংশ শিকার হচ্ছে অন্ধত্বের।
প্রসূতি মায়েদের পুষ্টিহীনতা ও অন্যান্য সমস্যার কারণেও চোখের সমস্যা নিয়ে জন্ম নিচ্ছে শিশু। সব মিলিয়ে দেশে শিশুদের চোখের সমস্যা দ্রুত বেড়ে চলছে।
গতকাল বুধবার ডেইলি সান, অরবিস ইন্টারন্যাশনাল ও কাতার ফান্ডের আয়োজনে ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়ার কনফারেন্স হলে শিশুদের অন্ধত্ব প্রতিরোধ বিষয়ে এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তারা এসব মতামত তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, ‘এ বিষয়ে যেমন ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি, তেমনি প্রয়োজন পর্যাপ্ত শিশু চক্ষু চিকিৎসক। ’
বৈঠকের প্রধান অতিথি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দেশের স্বাস্থ্য খাতের অনেক অগ্রগতি ও অর্জন হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে অনেক পুরস্কারও এসেছে। স্বাস্থ্যসেবায় দেশে অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, ওষুধ—সব কিছুতেই অনেক এগিয়েছে। তবে জনবলসংকট এখনো চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।
বিশেষ করে চোখের চিকিৎসক সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, যা বাড়ানোর জন্য নানাভাবে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরি করা হচ্ছে। ’
প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘জেলা পর্যায়ে অনেক স্থানেই চোখের চিকিৎসকের পদ আছে, কিন্তু আমরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে ওই শূন্য পদে লোক বসাতে পারছি না। তবে সচেতনতা বাড়াতে মাঠপর্যায়েও নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। স্কুল পর্যায়েও শিশুদের প্রাথমিক চক্ষুসেবার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ’
প্রতিমন্ত্রী দেশের মানুষের চক্ষুসেবায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তবে এ ক্ষেত্রে অর্থ আদায়ের পরামর্শ দেন। এ ছাড়া প্রতিমন্ত্রী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভেতরে যাদের চোখের সমস্যা রয়েছে তাদের সেবায় চক্ষু চিকিৎসকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
ডেইলি সানের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এনামুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং অরবিসের বাংলাদেশ প্রধান মুনীর আহম্মেদের সঞ্চালনায় এ গোলটেবিল বৈঠকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা চক্ষু সমস্যা, চিকিৎসা ও সেবা ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা মতামত ও পরামর্শ তুলে ধরেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অরবিসের পরিচালক (কর্মসূচি) মোহাম্মদ আলাউদ্দিন।
বৈঠকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, ‘একজন মানুষ যদি নিজের চোখে পৃথিবী এবং নিজেকে দেখতে না পান, এর চেয়ে দুর্বিষহ অবস্থা আর কিছুই হতে পারে না। তাই চোখের সমস্যায় আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষকে যেমন সচেতন করতে হবে, তেমনি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার পরিধি আরো বাড়াতে হবে। ’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ও জাতীয় চক্ষুসেবা কার্যক্রমের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন একটি জরিপের বরাত দিয়ে বলেন, ‘শিশুরা নিজের চোখের সমস্যা নিজেরা বুঝতে ও বোঝাতে পারে না। ২০ শতাংশ অভিভাবকই নিজের শিশুর চোখের সমস্যা সময়মতো জানতে পারেন না। আবার অনেকে জেনেও এ বিষয়ে অবহেলার কারণে তাঁদের শিশু অন্ধত্বের শিকার হয়। শহরে কিছুটা সচেতনতা থাকলেও গ্রামে এ পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রমকে আরো সক্রিয় করে স্কুল পর্যায়ের শিশুদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে। ’
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘সরকার ইতিমধ্যে দেশে মাঠপর্যায়ে ২০০ ভিশন সেন্টার গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে জেলা পর্যায়ে চক্ষু চিকিৎসকদের সংকট খুবই প্রকট। প্রতিটি জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে অন্ততপক্ষে একজন করে হলেও চক্ষু চিকিৎসক নিয়মিতভাবে রাখার ব্যবস্থা করা জরুরি। এ ছাড়া শূন্য পদগুলো পূরণ না হলে সংকট আরো বাড়বে। ’
শিশু চক্ষু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির এক উদাহরণ তুলে ধরে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু চক্ষু বিভাগের অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘গত বছর আমাদের প্রতিষ্ঠানে মোট ৬২ হাজার ৪৭০টি শিশু চোখের চিকিৎসা নিয়েছে। কিন্তু এ বছর গত আট মাসে ওই সংখ্যা ৫৮ হাজারে উঠেছে। ফলে তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, শিশুদের মধ্যে সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় শিশু চক্ষু বিশেষজ্ঞ খুবই নগণ্য। ’
অন্য বক্তারা চোখের অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, পর্যাপ্ত লো ভিশন সেন্টার, চশমার দাম কমানো, নির্ভুল পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিশ্চিত করা, প্রসূতি মায়েদের উপযুক্ত পুষ্টি ও চিকিৎসার ওপর জোর দেন।
অরবিসের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে চক্ষুসেবা কার্যক্রমে অরবিস সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ এগিয়ে নিচ্ছে। চিকিৎসা সুবিধার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে উপকরণ ও প্রশিক্ষণ দিয়েও সহায়তা করছে সরকারকে।