দুই ঘণ্টার বৃষ্টিতে আবার ডুবল ঢাকা রাজধানীর রাজপথে নৌকা

0
1408

নিজস্ব প্রতিবেদক   | নিমেষেই যেন হারিয়ে গেল রাজধানীর সড়কগুলো। রাজপথজুড়ে থইথই জল। হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে যানবাহনের ধাক্কায় সৃষ্ট ঢেউয়ে কোনো কোনো সড়ক নদীতে রূপ নিল। কোথাও কোথাও ভাসল ভেলা, নৌকা। সকালে হেঁটে কর্মস্থলে গেলেও দুপুরে কাউকে কাউকে সাঁতরাতে হলো রাস্তায়। দেখতে দেখতে সড়কে বেড়ে গেল পানির উচ্চতা। চলতে থাকা অটোরিকশার মাঝ পর্যন্ত ডুবে গেল। থেমে গেল অনেক চলন্ত বাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন। গাড়ি ছেড়ে রিকশায় ওঠা গেল না। কারণ রিকশাও ডুবুডুবু। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘণ্টা দেড়েক হালকা বৃষ্টির পর এক ঘণ্টার ভারি বর্ষণেই ঢাকার প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

Advertisement

শান্তিনগরে আটকে পড়া লোকজনের পারাপারের জন্য ডুবে যাওয়া সড়কে নামানো হয় লাইফ বোট। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ওই লাইফ বোট দিয়ে লোকজনকে সড়ক পার করিয়ে দেন।

গতকাল দুপুর ২টায় শান্তিনগরে কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘পা দিলেই গর্ত পাচ্ছি। কোথাও হয়তো ম্যানহোল খোলা। কোথায় হাঁটব?’

ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক পলাশ চন্দ্র মোদক  বলেন, ‘আমাদের মহাপরিচালকের নির্দেশে মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে আর্টিফিশিয়াল নৌকা দিয়ে মানুষকে পারাপার করেছি। শান্তিনগর, নটর ডেম কলেজ, মতিঝিল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এলাকায় আমাদের টিম কাজ করেছে। ’

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে রাজধানীতে ১২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগের দিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছিল ২৪ মিলিমিটার। আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গতকালের বৃষ্টিপাত ছিল আগের দিনের পাঁচ গুণেরও বেশি। বর্ষার শুরুতে গত ১২-১৩ জুন ২৪ ঘণ্টায় ১৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল ঢাকায়। ১৩ জুলাই বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল ১০৩ মিলিমিটার। গত ২৬ জুলাই রাতে মাত্র ৬৭ মিলিমিটারের বৃষ্টিতে নগরবাসীকে জলজট ও যানজটের তীব্রতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

গতকাল বৃষ্টিতে ঢাকার অর্ধেক এলাকার সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যায়। ভাঙাচোরা সড়কে জলজট ও যানজটে নাকাল হয়েছে নগরবাসী। সামান্য দূরত্ব পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৩টার কিছু সময় পর পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন নৌকা দিয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পারাপারের কাজ করেন।

মিরপুর, পল্টন, মতিঝিল, কারওয়ান বাজার, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, মালিবাগ, শান্তিনগর, রামপুরা এবং পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হয়েছে অন্যান্য এলাকায়। তবে কুড়িল, বাড্ডা, প্রগতি সরণি, গুলশান, বনানীসহ মহানগরের বেশ কিছু এলাকায় তেমন একটা বৃষ্টি হয়নি।

এলিফ্যান্ট রোড, বাটা সিগন্যাল, কারওয়ান বাজার এলাকায় তীব্র যানজট দেখা গেছে। গাবতলী, টেকনিক্যাল, মিরপুর-১, মাজার রোড এলাকায় সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মিরপুরের অলিগলিতে এত পানি আগে কখনো জমেনি বলে জানায় এলাকার একাধিক বাসিন্দা। শেওড়াপাড়ার বোম্বাই গলি, পীরেরবাগ এলাকার সব রাস্তাই গতকাল ডুবে যায়। পুরানা পল্টন, সেগুনবাগিচা, শিল্পকলা একাডেমি, সচিবালয় এলাকার সব সড়কই ছিল পানির নিচে। হাঁটুপানি ডিঙিয়ে চলাচল করতে হয়েছে এসব সড়কে। হাতিরপুল বাজার এলাকার সড়কগুলো পানির নিচে তলিয়ে ছিল। বাস, মাইক্রোবাস, রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার জটে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হয়েছে যাত্রীরা।

কারওয়ান বাজারে সোনারগাঁও হোটেলের সামনের অংশে কোমরপানিতে নাকাল হতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন সরকারী কর্মচারী আসাদুজ্জামান আপেল। তিনি বলেন, ‘অফিস ছুটির পর রাস্তায় বেরিয়ে বেশি ভাড়া দিয়ে রিকশায় উঠে বসি। কারওয়ান বাজার এলাকায় যাওয়ার পর রিকশা বডি পর্যন্ত পানিতে ডুবে যায়। ’

বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়া পুরানা পল্টন এলাকার সড়কগুলোতে অনেক মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার বিকল হয়ে আটকে থাকতে দেখা যায়। মতিঝিলের সড়কগুলোও পানিতে তলিয়ে যায়। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে জমে যায় হাঁটুপানি। অফিস ছুটির পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জুতা খুলে প্যান্ট গুটিয়ে পানি ভেঙে যানবাহনে উঠতে দেখা যায়। এমন দৃশ্য রাজধানীর আরো অনেক এলাকায়ই চোখে পড়ে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের ওপর মৌসুমি বায়ু মোটামুটি সক্রিয় রয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে এটি মাঝারি অবস্থায় রয়েছে। আজ শুক্রবার দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ভারি ও ভারি বর্ষণ হতে পারে। আগামী কয়েক দিন বৃষ্টির প্রবণতা থাকবে।

শান্তিনগর এলাকা গতকাল দীর্ঘ সময় ডুবে ছিল। গত কয়েক বছর পানি জমার পর সেখানে একটি প্রকল্প নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে গত বছরের জুন মাসে জলাবদ্ধতা নিরসনে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। ওই প্রকল্পে পানি নিষ্কাশনের জন্য চারদিকে ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নত করা হয়েছে। কিন্তু অধিক বৃষ্টি হলে মানিকনগর এলাকায় থাকা ওয়াসার পাম্পটি কাজ করতে পারে না। ফলে শান্তিনগরে পানি জমে যায়। তবে আমাদের সব উন্নয়নকাজ শেষ হলে পানি খুব একটা জমে থাকবে না। ’

নটর ডেম কলেজের সামনের রাস্তা, মতিঝিল আইডিয়াল, নয়াপল্টন, কাকরাইল এলাকার কয়েকটি রাস্তায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এতে গাড়ি চলাচলে সমস্যা হওয়ায় দেখা দেয় তীব্র যানজট। ফলে মতিঝিল ও আশপাশের রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী লোকজনকে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়। জলাবদ্ধতা ও তীব্র যানজটের কারণে মতিঝিল থেকে কারওয়ান বাজারগামী যাত্রীদের দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে বলে জানা গেছে।

পুরান ঢাকার পথঘাট ভেসে যায়। পথে যেন সাঁতরে পাড়ি দিয়েছে মানুষজন। মোটরসাইকেল আরোহী ও চালকদের অবস্থা ছিল বেশি শোচনীয়। আইনজীবী আব্দুল আহাদ শাকিল বলেন, ‘পুরান ঢাকার অলিগলির রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। আদালতের কাজ শেষ করে লক্ষ্মীবাজার আসার পর মোটরসাইকেলটিও অর্ধেকের বেশি পানির নিচে থাকে। কিছু পথ যাওয়ার পর তা বন্ধই হয়ে যায়। শুরু হয় ভোগান্তি। নোংরা পানির মধ্যে মোটরসাইকেল ঠেলে ঠেলে পথ চলতে হয়েছে। ’ আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন জানান, কোর্ট হাউস স্ট্রিট, জনসন রোড, সিএমএম আদালত ও জেলা জজ আদালত ভবন এলাকায় কোমরসমান পানি জমেছে।

মিরপুর টোলারবাগের বাসিন্দা আহম্মেদ মোরশেদ পিন্টু বলেন, ৩০-৪০ মিনিট বৃষ্টির পরই মিরপুরের প্রধান সড়ক দারুস সালাম রোড পানিতে তলিয়ে যায়। ব্যাপক পানি থাকায় চার লেনের সড়কে এক লেনে যানবাহন চলে। দীর্ঘ জটলা তৈরি হয়। বাসাবাড়ি থেকে রাত পর্যন্ত বের হওয়ার খুব একটা সুযোগ ছিল না।

 

Advertisement

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here