নিম্ন আদালতে বিচারাধীন ত্রিশ লাখ মামলার জট নিরসনে সরকার যখন একের পর এক কৌশল নির্ধারণে হিমশিম খাচ্ছে তখন দুই বছরে প্রায় সাড়ে চার লাখ মামলা নিষ্পত্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। বিচারের মান, মামলা নিষ্পত্তি, প্রশাসনিক উদ্যোগ ও বিভিন্ন যুগোপযোগী সংস্কারের ফলে বিচারপ্রার্থী, আইনজীবীদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে এই আদালত। আদালতের আধুনিকায়ন, ডিজিটালাইজেশন, স্বচ্ছতা ও নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার রূপকার হিসেবে কাজ করেছেন চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শেখ হাফিজুর রহমান…এবিএম শাহজাহান আকন্দ প্রতীকী ছবিনিম্ন আদালতে বিচারাধীন ত্রিশ লাখ মামলার জট নিরসনে সরকার যখন একের পর এক কৌশল নির্ধারণে হিমশিম খাচ্ছে তখন দুই বছরে প্রায় সাড়ে চার লাখ মামলা নিষ্পত্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। বিচারের মান, মামলা নিষ্পত্তি, প্রশাসনিক উদ্যোগ ও বিভিন্ন যুগোপযোগী সংস্কারের ফলে বিচারপ্রার্থী, আইনজীবীদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে এই আদালত। আদালতের আধুনিকায়ন, ডিজিটালাইজেশন, স্বচ্ছতা ও নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার রূপকার হিসেবে কাজ করেছেন চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শেখ হাফিজুর রহমান।
মামলা নিষ্পত্তি : ঢাকার সিএমএম হিসেবে শেখ হাফিজুর রহমানের যোগদানের সময় বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩,০৩,৪১৮টি। মামলার শ্রেণি ও প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে তিনি দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে পদক্ষেপ নেন। মোটরযান আইনে তৎকালীন বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ১,৫৯,২৫০টি। মোটরযান আইনের প্রসিকিউশন রিপোর্টগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, সিংহভাগ প্রসিকিউশন রিপোর্ট আইনত ত্রুটিপূর্ণ। আসামির নাম, ঠিকানা, অভিযোগকারীর নাম, ঠিকানা, ঘটনাস্থলের বিবরণ, সাক্ষীদের নাম প্রসিকিউশন রিপোর্টে নেই। এ ধরনের মামলাগুলো তিনি আইনানুগ পথে নিষ্পত্তির নির্দেশনা প্রদান করেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে জুলাই ২০১৭ পর্যন্ত মোটরযান আইনের ২,১৭,৯৪০টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। মামলা বিচারাধীন আছে ৪৯,২৮৪টি। যেসব মামলা আইনানুগ পদ্ধতিতে দায়ের করা হয়েছে সেসব মামলায় প্রসিকিউশন রিপোর্ট গ্রহণ করে আসামিদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রসেস ইস্যু করা হয়েছে।
দায়িত্ব পাওয়ার পরই তিনি প্রতিটি আদালত থেকে মামলার পরিসংখ্যান তলব করেন। এর পরে মামলার শ্রেণিকরণ করে পুরাতন মামলা (২০১০-এর আগের দায়েরকৃত মামলা) অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির নির্দেশনা প্রদান করেন। ফৌজদারি মামলার দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ হলো পুলিশ কর্তৃক সঠিক সময়ে সাক্ষীকে আদালতে হাজির না করা। সিএমএম মহোদয় দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই এ সমস্যা নিরুপণে উদ্যোগ নেন। সাক্ষীর সমন, ডাবিস্নউ/ডাবিস্নউ, এনবি/ডাবিস্নউ ডাবিস্নউ সঠিকভাবে ইস্যু করা হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান করার জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতগুলোকে নির্দেশনা দেন। পুলিশ কর্তৃক সাক্ষী সঠিক সময়ে উপস্থাপিত না হলে সাক্ষীর প্রতি ইস্যুকৃত প্রসেস পুলিশ কমিশনার ও আইজিপির মাধ্যমে প্রেরণের নির্দেশ দেন। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৮৫এ ধারা প্রয়োগ করতে বলেন। অনেক সময় দেখা যায় যে একই ম্যাজিস্ট্রেট/ ডাক্তার/ তদন্তকারী কর্মকর্তা এক আদালতের অনেক মামলার সাক্ষী। সিএমএম মহোদয় এ ধরনের মামলা চিহ্নিত করে সেসব মামলার তারিখ একই দিন ধার্য্য এবং একই দিনে যাতে তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতগুলোকে নির্দেশনা প্রদান করেন। ফলে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি এবং আদালতের কর্মঘণ্টার অপচয় রোধ হয়। ২০১৪ সালে বর্তমান সিএমএম যোগদানের আগের বছর সিএমএম আদালত মোট নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ছিল ১,০১,৪৪৯টি। বর্তমান সিএমএম যোগদানের তারিখ থেকে অর্থাৎ গত ০৬/০৮/১৫ থেকে জুলাই ২০১৭ তারিখ পর্যন্ত নিষ্পত্তিকৃত মোট মামলার সংখ্যা ৪,৪২,৯৯৪টি। বর্তমানে সিএমএম আদালতে ২,০৫,৫২৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
প্রশাসনিক উদ্যোগ : ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বর্তমান সিএমএম মহোদয় প্রতিদিন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের রিমান্ড ও জামিন শুনানির অধিক্ষেত্র পরিবর্তন করেন। এ পরিবর্তনের ফলে বিচারে অহেতুক হস্তক্ষেপ ও দালাল টাউটদের দৌরাত্ম্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। উল্লেখ্য, আগে রিমান্ড ও জামিন শুনানির অধিক্ষেত্র সপ্তাহান্তে একবার পরিবর্তন করা হতো।
এ ছাড়া প্রতিটি আদালতের আদেশ প্রতিদিন প্রয়োজন মতে তিনি পর্যালোচনা করে থাকেন। কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেন। বিচারপ্রার্থী জনগণের উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট সিএমএম মহোদয়ের বিভিন্ন আদেশ প্রকাশ্য নোটিশ বোর্ডে লটকিয়ে দেয়া হয়। এ ছাড়া এসব আদেশ সংশ্লিষ্ট বিচারক, জিআর সেকশন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় শাখায় ই-মেইলের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়ে থাকে। অতি সম্প্রতি তিনি বিচারপ্রার্থী জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে দুটি হেল্পডেস্ক খোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। হেল্পডেস্কগুলো জনগণকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে।
সিএমএম আদালতের মূল ভবনটি ১০ তলা। বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য লিফটের সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। তিনি নতুন একটি লিফট উদ্বোধনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও জনগণের কষ্ট লাঘব করতে সমর্থ হয়েছেন। বিচারিক কাজের পরিবেশ সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন করার জন্য তিনি আদালতে সৌন্দর্য বর্ধনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন। এ ছাড়া দেশের চলমান পরিস্থিতিতে বিচারক আইনজীবীরা জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মূল ভবনের সামনে মেটাল ডিটেক্টর স্থাপন করেছেন। সম্প্রতি সব আদালতে অনলাইনে কজলিস্ট চালু হয়েছে। বিচারপ্রার্থী জনগণ যে কোনো স্থান থেকে তাদের মামলার আদেশ ও পরবর্তী তারিখ মুহূর্তেই জানতে পারছে। অনেক টাউট দালাল ভুয়া ওয়ারেন্টের মাধ্যমে জনগণকে হয়রানি করে থাকে। বর্তমান সিএমএম মহোদয় দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই এ বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নেন।
তিনি জড়িতদের শনাক্ত করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের নির্দেশনা দেন। তার গৃহীত পদক্ষেপের ফলে সিএমএম আদালতে ভুয়া ওয়ারেন্টের সংখ্যা অনেকাংশে কমে গেছে। তার এসব উদ্যোগ বিচারসংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে স্বস্তি এনেছে।
ডিজিটাল হাজিরা পদ্ধতি উদ্ভাবন : প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি ‘ভিশন-২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গত ০১/০২/২০১৭ তারিখ সকাল ৯ ঘটিকায় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ডিজিটাল হাজিরার শুভ উদ্বোধন করা হয়। আদালতের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের সঠিক সময়ে আদালতে উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থী জনসাধারণের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ‘ডিজিটাল এটেনডেন্স মেশিন’ স্থাপন করা হয়। উদ্বোধনকালে সিএমএম মহোদয় বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নের সঙ্গে অংশীদার হতে পেরে আমরা গর্বিত। তিনি আশা প্রকাশ করেন ডিজিটাল হাজিরা পদ্ধতির মাধ্যমে অত্র আদালতের কর্মচারীদের সঠিক সময়ে আদালতে আগমন ও প্রস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। যার ফলে সাধারণ বিচারপ্রার্থী জনগণ সর্বোচ্চ সেবা পাবে। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; সম্পাদক, বিডিল’নিউজ ডটকম; ফিচার সম্পাদক, আইন পাতা, দৈনিক বাংলাদেশ টুডে;