পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় লাশ দেখার পর

0
1042

২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে ১৩ দফা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী। শুরুতে শান্তিপূর্ণ অবস্থান হলেও পরে তা তা-বে রূপ নেয়। শাপলা চত্বরের জমায়েত ছড়িয়ে পড়ে পল্টন ও বায়তুল মোকাররম পর্যন্ত। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি তাদের সমর্থন জানায়। পরে রাতে অভিযানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ওই আন্দোলনের। সেদিনের পরিস্থিতি ও হেফাজত ইসলামের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমাদের সময়ের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন জুনায়েদ বাবুনগরী।

Advertisement

-শাপলা চত্বরের জমায়েতের সময় আপনি কোথায় ছিলেন?

= আমি দুপুর পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। এর পর লালবাগ জামে মসজিদে চলে যাই। সেখানে আসর ও মাগরিবের নামাজ আদায় করি। মাগরিবের নামাজের পর সেখান থেকে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

-কতদিন পর মুক্তি পান?

= রিমান্ডে এবং জেলখানায় মোট ১৮ দিন ছিলাম। আমার আগে থেকেই ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগ ছিল। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়। আমি উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে চেয়েছিলাম। সরকার গত দুই বছরেও আমাকে পাসপোর্ট তৈরির অনুমতি দেয়নি। ফলে আমার আর উন্নত চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয়নি।

-আপনার বিরুদ্ধে কয়টি মামলা এবং সেগুলোর কী অবস্থা?

= শুনেছি আমার বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা আছে। তবে আমাকে তিনটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই তিন মামলায় জামিন পাওয়ার পর জেল থেকে বের হই। অবশিষ্ট মামলাগুলোর কী অবস্থা জানি না। পুলিশ বলেছে, অন্য মামলাগুলো ঝুলিয়ে রেখেছে। পুলিশের সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি, তাদের অনেকেই আমার মামলাগুলোর সত্যতা নিয়ে সন্দিহান। এক রাতে ৩০০ গাছ কাটার মামলাও আমার বিরুদ্ধে করা হয়। আসলে কে বা কারা গাছ কাটে আমরা জানি না। যাদের মাথায় এসব চিন্তা ছিল তারাই গাছ কেটেছে। আমরা রাসুলের (স) সম্মানার্থে শাপলা চত্বরে গিয়েছিলাম জায়নামাজ ও তসবিহ নিয়ে। আমাদের দাবি ছিল ১৩ দফা। হাঙ্গামা, দখল, সচিবালয় ঘেরাও কিংবা সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করার কোনো কিছুই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না।

-পরে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। আপনারা জোহরের নামাজের পর জমায়েত সমাপ্তি ঘোষণার কথা বললেও, রাতেও হেফাজতের কর্মীরা শাপলা চত্বর ও পল্টনে অবস্থান নিয়ে থাকেন।

=কথা ছিল জোহরের পর শেষ হবে। জোহরের নামাজের পর আমরা একটু দোয়া-দরুদ পাঠ ও মোনাজাত করি। কোনো কোনো মাওলানা একটু ওয়াজ করেন। এর পরই চলে আসার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশ ও সরকারের অন্যান্য বাহিনী জোহর থেকেই আমাদের লোকজনকে পেটাতে শুরু করে। এতে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। আমাদের লোকজনকে পিটিয়ে আহত ও নিহত করা হলে অন্যরা শাপলা চত্বর না ছাড়ার ঘোষণা দেন। তখন তাদের বলেও সেখান থেকে সরানো যায়নি। আমি নিজের চোখে চারজনের লাশ দেখেছি। এ অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আমাদের কর্মীরা নিহতদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত শাপলা চত্বর ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।

-কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি কোনো কাজে আসবে?

=কওমি সনদের কোনো কমিটিতে আমি নেই। এটা হেফাজতের ব্যানারেও হয়নি। এটা হয়েছে কওমি মাদ্রাসার ছয় শিক্ষাবোর্ডের ব্যানারে। কাজেই কমিটিতে যারা আছেন তাদের উদ্দেশ্য কী বা সরকারের উদ্দেশ্য কী তা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরাই বলতে পারবেন। হেফাজত আর কওমি শিক্ষা সম্পূর্ণ আলাদা। হেফাজত হচ্ছে একটি আন্দোলনের নাম। আর কওমি মাদ্রাসা হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

-দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এটা কী কাজে আসবে?

=আশা তো করা যায় কাজে আসবে। তবে সুনিশ্চিত করে তো ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলা যায় না। বিষয়টি নিয়ে আমি বেশি কিছু বলব না। কারণ আমি এ সংক্রান্ত কমিটিতে নেই, দায়িত্বশীলও নই। আমি হেফাজত আর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা নিয়ে আছি। সনদ বেফাকের বিষয়। জার্মানির এক সাংবাদিকও আমাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেন। তাকেও একই উত্তর দিয়েছি।

-সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে গ্রিক দেবীর মূর্তি অপসারণে আপনারা দাবি দিয়েছিলেন, সেটির কী অবস্থা?

=আমরা দাবি থেকে সরিনি। মাহে রমজানের পবিত্রতা রক্ষার্থে সেটি সরাতেই হবে। এটিকে বোরকা পরিয়ে দেওয়া, কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখার মতো যেসব প্রস্তাব এসেছে, সেগুলো হাস্যকর। মূর্তিকে খোলা রাখা যা, ঢেকে রাখাও তা। প্রধানমন্ত্রী ১১ তারিখ গণভবনে আমাদের ওয়াদা দিয়েছেন। বলেছেন, আমার ওপর আস্থা রাখেন। আমি মূর্তির বিষয়ে কিছু করব। কাজেই আশা করছি রমজানের আগেই সেটি সরানো হবে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী লাখো-কোটি মানুষের মনের ভাষা বুঝবেন। তিনি এটি সরিয়ে সবাইকে শান্ত করবেন।

একটা কথা বলি, মূর্তিটি বসানো হয়েছে, তা আদালতের নির্দেশে নয়, বসানো হয়েছে কিছু আইনজীবীর ইচ্ছায়। কাজেই মূর্তিবিরোধী আন্দোলনে আদালতের অবমাননা হবে না। আমি বিভিন্ন সমাবেশে বলেছি, এদেশের হিন্দু ভাইয়েরা নিজেদের অফিস কিংবা মন্দিরে মূর্তি বসান, পূজা করেন। আমাদের আপত্তি নেই। আমাদের মাদ্রাসার পাশেই সবচেয়ে বড় মন্দির আছে। কিন্তু ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে সর্বোচ্চ স্থানে মূর্তি থাকতে পারে না। গ্রিক মূর্তি এটি হিন্দুদেরও না খ্রিস্টানদেরও না। কেউ এটিকে ভালবাসে না। এটি এদেশের সংস্কৃতির অংশও নয়। আমরা ভাস্কর্যবিরোধী নই, সংস্কৃতিবিরোধীও নই। এদেশের সংস্কৃতি ও ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে মিল আছে এমন ভাস্কর্য বসালে আমাদের আপত্তি নেই। মূর্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর পর প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, এটা কে বসিয়েছে আমি তো জানি না। সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে মূর্তি বসানো হচ্ছে আর প্রধানমন্ত্রী তা জানেন না?

-আপনাদের ১৩ দফা আন্দোলন সম্পর্কে অনেক কথা শোনা যায়। অভিযোগ রয়েছে, আন্দোলনের বিষয়টি স্তিমিত আর হেফাজত ও সরকার কাছাকাছি অবস্থান করছে।

=এ ধরনের কথাবার্তা ঠিক নয়। হেফাজত নিজের অবস্থানেই আছে। আমাদের দাবি-দাওয়া আছে। তবে আন্দোলন হচ্ছে না। ১৩ দফা দাবি বাদ দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে সরকারের কোনো ধরনের সমঝোতা হয়নি। সরকার কৌশলগতভাবে আমাদের দমিয়ে রাখতে পারে। সরকারের ভাবনায় তা থাকতে পারে। তবে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের গোপন বৈঠক বা লিয়াজোঁ হয়নি। অনেকে সনদের বিষয় বলেন। আসলে সনদ আর হেফাজত আলাদা বিষয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।

সরকার যদি মামলা দিয়ে আমাদের চাপে রাখতে চায়, তার পরও আমাদের তো কথা বলতে হবে। সরকারবিরোধী আন্দোলন আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব কার্যকলাম দেখা যাচ্ছে, সেসব নিয়ে কথা বলাই আমাদের উদ্দেশ্য। গ্রিক দেবী, পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে আমাদের কথা বলতেই হবে। সরকার কিংবা বিরোধী দলের সঙ্গে আমাদের কোনো চুক্তি হয়নি। সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের ভূমিকা নেই। তবে মুরতাদ-নাস্তিকদের বিরুদ্ধে আমাদের ভূমিকা আছে, থাকবে।

-সরকারের সঙ্গে সমঝোতা যদি না হয়েই থাকে, তবে বিভিন্ন সময় সভা-সমাবেশের ঘোষণা দিয়ে আবার পেছানো হয় কেন?

=অনেক সময় সভা-সমাবেশের দিন-তারিখ বদলে যায়। পরে আবার রেসালত সম্মেলন হয়। হেফাজত কোনো রাজনীতিতে জড়াবে না। আমাদের আমিরও এটা স্পষ্ট করেছেন। রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন আমাদের উদ্দেশ্য নয়।

-হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে তো চার দলের জোটের শরিক দলের নেতারাও আছেন। সেক্ষেত্রে তো তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ থাকে।

=দেখুন একজন মানুষ একই সঙ্গে প্রকৌশলী ও শিক্ষক হতে পারেন। সেভাবেই কেউ হেফাজতে আছেন আবার রাজনৈতিক দলেও আছেন। তিনি যখন হেফাজতে আসেন, তখন তাকে দল বাদ দিয়েই আসতে হয়। আবার দলে ফিরে গেলে রাজনীতি করতে পারবেন।

-৫ মে শাপলা চত্বরের বার্ষিকী। কোনো কর্মসূচি আছে?

=আপাতত কর্মসূচি নেই। তবে ১৩ দফা বহাল আছে। কওমি মাদ্রাসার সদনের স্বীকৃতি আর ১৩ দফা প্রত্যাহার এ ধরনের সমঝোতা সরকারের সঙ্গে হয়নি। এটা সরকারও বলেনি, আমরাও বলিনি।

-তাহলে হেফাজত এখন মাঠে নিষ্ক্রিয় কেন?

=আমরা তো সব সময় মাঠে পড়ে থাকতে পারি না। রাষ্ট্রধর্ম, লতিফ সিদ্দিকী, বই-পুস্তক থেকে ইসলামবিরোধী লেখকদের প্রত্যাহার নিয়ে আমরা সফল হয়েছি। ইসলামবিরোধী কিছু হলেই আমরা আওয়াজ তুলব। রাজনীতিবিদদের মতো আমরা তো মাঠে-ময়দানে থাকতে পারব না।

-বলেছিলেন, শাপলা চত্বরে অনেক নিখোঁজের কথা। চার বছর পরও আপনারা কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে পারেননি, কেন?

=আমরা একটি উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এখনো তা শেষ করতে পারিনি। অনেকে আহত-নিহত হয়েছিলেন। আহতদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ আছে।

-আপনাদের আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী?

=শাপলা চত্বরে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের রক্তের বিনিময়ে এদেশে একদিন ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

Advertisement

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here