‘ট্যানারির পানি এসে আমার পেঁপে ক্ষেত কোমর পানির উপরে গ্যাছেগা। এইখানে আর চাষাবাদ করার অবস্থা নাই, নৌকা বাওয়া যাইব’- সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প নগরীর শেষ সীমানা পার হয়ে গ্রামের একটি বাজারের কাছে যেতেই স্থানীয় বাসিন্দা বিল্লাল হোসেনের অভিযোগ।
সেই বাজারের পাশেই নদী। তবে গন্ধের কারণে খুব একটা কাছে যাওয়া যায় না। পাশেই চামড়া নগরীর বর্জ্যের বিশাল ভাগাড়। বড় পুকুরের মতো একটি স্থানে কারখানাগুলোর সব ধরনের বর্জ্য এনে ফেলা হচ্ছে। এই চামড়া শিল্প নগরীটি তৈরি হয়েছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন বা বিসিকের তত্ত্বাবধানে।
কারখানা থেকে আনা বর্জ্য ফেলার বিষয়টি তদারক করছিলেন বিসিকের নিয়োজিত একজন কর্মচারী রোকনুজ্জামান। তিনি জানালেন, আশপাশের কারখানাগুলোর যত কঠিন বর্জ্য আছে সবই এখানে ফেলা হয়। যদিও এখানে একটি পরিবেশসম্মত ডাম্পিং জোন এবং সেই কঠিন বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করার কথা ছিল, তার কিছুই এখনো হয়নি। কবে হবে সেটাও কেউ বলতে পারছে না।
এই বর্জ্যের তরল অংশটি ভেসে পড়ছে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীতে। চামড়া কারখানা স্থাপন হবার পর থেকে নদীর এই অংশে মাছ মরে ভেসে ওঠার ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকবার। এলাকার লোকজন বলছেন, এরপরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমরা গেলে বলে সরকারকে বলতে, আমরা সরকার কই বিচরামু- ক্ষুব্ধ আরেক এলাকাবাসীর বক্তব্য।
চামড়া শিল্পাঞ্চলের পার্শ্ববর্তী নদীতে এ বছর সমীক্ষা চালিয়ে অতিরিক্ত ক্রোমিয়াম এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। কেন্দ্রীয় যে দুটি পরিশোধনাগার হবার কথা ছিল, তার একটি কয়েক দফা সময় পেছানোর পর চালু হয়েছে বলছে বিসিক। কিন্তু অপরটি এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। চালু হতে আরো সময়ের প্রয়োজন হবে বলছেন তারা। শিল্প নগরীর ভেতরে বিসিকের প্রকল্প কার্যালয়ে কথা হচ্ছিল প্রকল্পের উপব্যবস্থাপক মোস্তফা মজুমদারের সাথে। তিনি অবশ্য দাবি করলেন, মাছ যে ট্যানারির রাসায়নিক পদার্থের কারণেই মারা গেছে তার কোনো প্রমাণ নেই। তবে তিনি বললেন, দূষণের দায় কিছুটা ট্যানারি মালিকদেরও আছে, কারণ কারখানাগুলোও শোধনাগারের জন্য যেভাবে তাদের তরল বর্জ্য সরবরাহ করা প্রয়োজন সেভাবে করছে না।
তারা ক্রোম এবং চুনের পানি মিশিয়ে বর্জ্য দিচ্ছে, কিন্তু সেগুলো দেওয়ার কথা ছিল আলাদা। বলেন মজুমদার। কেন্দ্রীয় শোধনাগারের সবগুলো ইউনিট কবে চালু হবে সেটি স্পষ্ট করে বলতে পারলেন না তিনি। কিন্তু কাজগুলো সম্পন্ন হবার কথা ছিল অনেক আগেই। যে ১৫৫টি কারখানা এখানে স্থানান্তর করার কথা ছিল, তার মধ্যে এসেছে ৮০টির মতো। কয়েকটি বড় কারখানা ছাড়া অন্যান্যগুলোর নির্মাণকাজ এখনো চলছে। এদিকে ঢাকার হাজারীবাগে গত এপ্রিলেই কারখানাগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও বিভিন্ন কারখানা নানাভাবে সংযোগ নিয়ে কিছু কাজ এখনো করে যাচ্ছেন। হেমায়েতপুরের শিল্পাঞ্চলজুড়ে রাস্তায় একটু পর পর জমে আছে নোংরা দুর্গন্ধময় পানি। কিছু রাস্তায় হাটা সম্ভব নয়, আর কিছু রাস্তা ছোট গাড়ি চলাচলেরও উপযুক্ত নেই। এসব নিয়ে অভিযোগ করছেন শিল্প মালিকরা এবং এই অজুহাতে কিছু কাজ হাজারীবাগেও চালিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ।
চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম ঈদুল আজহার সময়ে সরকার থেকে কাঁচা চামড়া হেমায়েতপুরে আনতে হবে বলার পরও হাজারীবাগেও চলেছে কাঁচা চামড়া আনা। ফলে একদিকে সাভারেও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, অন্যদিকে হাজারীবাগ থেকেও পুরোপুরি সরে যায়নি চামড়াশিল্প। শিল্পাঞ্চলে ঢাকা হাইড অ্যান্ড স্কিনের কারখানায় কথা হলো কারখানার একজন পরিচালক রফিকুল ইসলামের সাথে। তিনি বলছিলেন, তাদের কারখানার পুরো কার্যক্রম এখানে এসেছে। তবে কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের। আমাদের রাস্তাঘাটগুলোর খুবই বাজে অবস্থা। পানি জমে থাকে, বিভিন্ন ম্যানহোল থেকে কেমিক্যাল বের হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুতের খুবই সমস্যা, গ্যাসও ঠিকভাবে দেওয়া হয়নি।
ইসলাম বলেন, এসব সমস্যার কারণে ক্ষমতা অনুযায়ী তারা উৎপাদন করতে পারছেন না। মালিকদের সমস্যার পাশাপাশি আছে শ্রমিকদের সমস্যা। এখানে যে শ্রমিকরা কাজ করছেন তাদের অধিকাংশ এখনো হাজারীবাগ থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করেন। শ্রমিকরা বলছেন, ভালো আবাসন না থাকা, বাচ্চাদের স্কুল-কলেজের অপ্রতুলতা এবং রাস্তা-ঘাটের সমস্যার কারণে অনেকেই পরিবারসহ এখানে স্থানান্তর হতে পারছেন না। ট্যানারি চালু হওয়ার পর আশপাশে বাসার ভাড়াও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ট্যানারি শ্রমিক ইউনিয়নের একজন নেতা মোহাম্মদ লিয়াকত বলছিলেন, এসব সমস্যা তারা বারবার তুলে ধরার পরও কোনো ফলাফল পাননি।
মালিককে বললে বলে আমরাও বহুত কষ্টে আছি, কনস্ট্রাকশনে কোটি-কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। আমাদের বিষয়গুলো তারা এড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, এসব সমস্যা সমাধানে মালিক এবং সরকার দুজনেরই দায়িত্ব আছে। ট্রান্সফার হওয়ার জন্য মালিকরাতো কোটি-কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পাইছে, কিন্তু শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ কে দেবে? সব সমস্যারই সমাধান হবে বলে আশ্বস্ত করতে চাইছে বিসিক। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনীয়তার কথাই বারবার বলছেন তারা। কিন্তু এতবার সময় বাড়ানোর পরও কেন আরো সময় প্রয়োজন হচ্ছে এবং কবে নাগাদ পুরোপুরি কাজটি শেষ হবে তার কোনো সদুত্তর তাদের কাছে নেই।
ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরানোর জন্য যে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো আন্দোলন করেছে তার একটি পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন, সংগঠনটির প্রধান আবু নাসের খান বলছিলেন, পুরো কাজটি ঠিকভাবে না হলে আরেকটি হাজারীবাগ তৈরি হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেশে প্রথম এতবড় একটা সেন্ট্রাল ইটিপি চালু করা হচ্ছে, সেটার জন্য কিছুটা সময় হয়তো লাগতে পারে। কিন্তু সময়টা যদি খুব বেশি নিয়ে নেওয়া হয় তাহলে আরেকটা হাজারীবাগ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এ ছাড়াও ক্রোমিয়াম রিকভারির প্লান্টটাও ঠিকভাবে হচ্ছে কীনা সেটাও দেখা দরকার।
এ ছাড়াও প্রাথমিকভাবে শিল্পাঞ্চলের ডাম্পইয়ার্ডের কঠিন বর্জ্য ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল। খান বলেন, সেটিও দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। পরিবেশবাদীরা বারবার বলছেন, আরেকটি হাজারীবাগ ঠেকাতে একদিকে যেমন পরিকল্পনা অনুযায়ী আধুনিক চামড়া শিল্প নগরীর কাজ দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদে এর রক্ষণাবেক্ষণও জরুরি। নাহলে এ শিল্প বারবার প্রশ্নের মুখেই থেকে যাবে।