জয় সরকার ঃ জ্ঞান একটি মোমবাতির আলোর মতো। শিক্ষার ক্ষেত্রে আলোর চেয়ে বড় রূপক আর হয় না। বর্তমান ও ভবিষ্যত সমস্যা সমাধানে বিদ্যা বা জ্ঞান প্রয়োজন। কথায় বলে, ধ্যানের চর্চা হয় গুহায়, ধর্মের চর্চা হয় মসজিদ-মন্দিরে, নীতির চর্চা হয় পরিবারে, বিদ্যার চর্চা হয় বিদ্যালয়ে। বিদ্যা চর্চার এমনি একটি বিদ্যাপীঠ হচ্ছে রংপুর সরকারি কলেজ। যেটি যুগ যুগ ধরে রংপুরসহ গোটা উত্তরাঞ্চলের মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো বিস্তার করে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে অনেক কীর্তির স্মৃতি ধারণ করে।
রংপুর নগরীর অফিসপাড়া হিসেবে পরিচিত কাচারিবাজার এলাকার উত্তরে স্টেডিয়ামের পাশে রাধাবল্লভ এলাকায় ৫ দশমিক ২৬ একর জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে রংপুর সরকারি কলেজ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ, শিক্ষকদের নিরবচ্ছিন্ন পাঠদান, শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব কলেজটিকে গৌরব অর্জনে বিভিন্নভাবে সাহায্য করছে। কলেজটি তার পড়াশুনার মান, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও খেলাধুলাসহ বিভিন্ন রকম কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সুস্থ সংস্কৃতিচর্চায় এই কলেজের শিক্ষার্থীরা সকল গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরাই এ অঞ্চলের তারুণ্যের প্রতিনিধি। স্থানীয় যেকোনো সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে পাশে থাকেন রংপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ রংপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের সুনাম রয়েছে সারাদেশ জুড়েও। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্ঞান লাভ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অনেকেই। বর্তমান সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক সচিব আবদুস সাত্তার, রংপুর সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টু এই কলেজেরই ছাত্র ছিলেন। এছাড়াও এই কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছেন।
কলেজটিতে বর্তমানে প্রায় ১৬ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছে এবং শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ৭৮ জন। বর্তমানে কলেজটিতে এইচএসসি, ডিগ্রি পাস কোর্স, ১৪ টি বিষয়ে অনার্স এবং ৭ টি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। এছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধা প্রদানের জন্য রোভার স্কাউট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি), বাঁধন (স্বেচ্ছায় রক্ত দাতাদের সংগঠন), বিতর্ক পরিষদ প্রভৃতি ছাত্র-বান্ধব প্রতিষ্ঠান চালু আছে। কলেজটিতে ভবন আছে চারটি। রয়েছে মসজিদ-মন্দির। রয়েছে বিশ্রামাগার। ক্যা¤পাসে মেয়েদের একটি ছাত্রীনিবাস ও ক্যা¤পাসের বাইরে ছেলেদের একটি ছাত্রাবাস রয়েছে (বর্তমানে ছাত্রাবাসটি বন্ধ রয়েছে)। তবে এরকম একটি ঐহিত্যবাহী ও স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে শ্রেণিকক্ষ ও হলরুম রয়েছে তা শিক্ষার্থীদের তুলনায় অপ্রতুল। প্রায় সময়েই শিক্ষার্থীরা কলেজে এসে ক্লাসরুম ফাঁকা না পাওয়ার কারণে ক্লাস করতে পারে না। অনেক সময় পরীক্ষার কারণে ক্লাস স্থগিত রাখা হয়।
কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের রসায়ন বিভাগের ছাত্র এসএম সুজন মিয়া, ইতিহাস বিভাগের আরিফুল ইসলাম ও ইয়াকুব আলীসহ উচ্চ মাধ্যমিকের একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, “শ্রেণীকক্ষ না থাকার কারণে আমাদেরকে অনেক সময় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ক্লাসের সময় ক্লাসরুম ফাঁকা পাওয়া যায় না। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে আমরা ক্লাস শুরু করতে পারি না। তাছাড়া কলেজে প্রায় সব সময়েই কোনো না কোনো বিভাগের পরীক্ষা চলে। পর্যাপ্ত কক্ষের অভাবে পরীক্ষা চলাকালীন সময়গুলোতে আমরা ক্লাস করতে পারি না। তাই আমাদের দাবি দ্রুত কলেজে পর্যাপ্ত শ্রেণী কক্ষের ব্যবস্থা করা হোক।
এ ব্যাপারে রংপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ কানিজ উম্মে নাজমা নাসরীন জানান, আমাদের কলেজের সুনাম ছড়িয়ে আছে দেশ-বিদেশে। আমরা সবসময় কলেজে ভালো পরিবেশ বজায় রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। আমাদের শিক্ষার্থী অনেক। সে তুলনায় শ্রেণিকক্ষ কম, সেটা ঠিক। তবে এই অপ্রতুলতা দূর করতে একটি ১০ তলা একাডেমিক ভবনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং তা পাশও হয়েছে।
প্রসঙ্গত, প্রফেসর এমাজ উদ্দিনের (পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি) ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং জেলার অনেক বিত্তবান ব্যক্তির সহযোগিতায় ১৯৬৩ সালের ২৫ জুলাই রংপুর কলেজ নামে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক এমাজ উদ্দিন, যিনি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন কলেজটি যেখানে অবস্থান করছে, শুরুটা অবশ্য সেখানে হয়নি। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কৈলাশরঞ্জন উচ্চবিদ্যালয়ে ও কালিধাম এলাকায় রাম বাবুর জমিদারবাড়িতে ক্লাস হতো। চলত শিক্ষার সকল কার্যক্রম। কলেজটির যাত্রা লগ্ন থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। প্রথমে শুধু উচ্চমাধ্যমিক ক্লাসের অনুমতি ছিল। পরে শিক্ষার মান বিবেচনা করে ১৯৬৫ সালে বিএ চালু করার অনুমতি মেলে। ১৯৬৭ সালে কলেজটি নিজস্ব ভবনে (বর্তমানের কলেজ) স্থানান্তর করা হয়। এরপর ১৯৭০ সালে বিএসসি চালু করার অনুমতি দেয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজটি জাতীয়করণ করা হয় ১৯৮৪ সালের ১ নভেম্বর। তখন থেকে নাম হয় রংপুর সরকারি কলেজ। ১৯৯৩ সালে কলেজটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়।