সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ তাঁর নাম ঠিক না হওয়া গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রাজনীতিবিদরাই আমাকে নেতা বানানোর টোপ দিয়েছিল। আমি সৌভাগ্যবান, আমি সেই ফাঁদে পা দেইনি। আমি সেনাপ্রধান হিসেবেই বিদায় নিয়েছি ‘ পেঙ্গুইন র্যানডম থেকে এই গ্রন্থ এখন সম্পাদনার টেবিলে। গ্রন্থটিতে সাবেক সেনাপ্রধান ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের অনেক চাঞ্চল্যকর এবং অজানা তথ্য উপস্থাপন করেছেন। গ্রন্থে তিনি দাবি করেছেন, ‘আমার কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না। রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিটি এসেছিল সুশীল সমাজ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেই।’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবার পরই, সেনাবাহিনী শুধু একটি নতুন নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হয় সে লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি কখনোই রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পোষণ করিনি।’
তিনি লিখেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবার পরপর, সেনা গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন সদস্য আমাকে জানায়, প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক সংস্কার চায়। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা স্বপ্রণোদিত হয়ে তাঁদের সঙ্গে (ডিজিএফআই) যোগাযোগ করেছে। তাঁরা (রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ) বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র না থাকলে, দেশে গণতন্ত্র অসম্ভব। প্রথমে আমি আমার সহকর্মীদের জানিয়ে দেই এটা তাঁদের বিষয়। আমরা এসবে নাক গলাব না। কিন্তু কিছুদিন পরই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান আমাকে জানান যে, সুশীল সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমি আপত্তি করলেও প্রধান উপদেষ্টা আমাকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে জনা বিশেক সুশীল সমাজের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তাঁরাও দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেন। ওই বৈঠকে প্রথম একজন সম্পাদক বলেন, ‘দুই নেত্রীকে দলের প্রধান রেখে বাংলাদেশের গণতন্ত্র অসম্ভব। তাঁরা এটাও বলেন, রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন দিলে সেই নির্বাচন হবে অর্থহীন। তাঁদের বক্তব্যের সূত্র ধরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক সংস্কার হাতে নেয়।’
জেনারেল মঈন তাঁর পান্ডুলিপিতে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে বৈঠকের কথা স্বীকার করেন। তিনি লিখেছেন, ‘ওই সব নেতারা আমাকে দ্রুত শেখ হাসিনার বিচার শেষ করে তাঁকে দণ্ডিত করার জন্য অনুরোধ করেন। তাঁরা এও আশ্বস্ত করেন, শেখ হাসিনা নির্বাচনের অযোগ্য হলেই, কেবল নির্বাচন দেওয়া উচিত।’ বিএনপির নেতারা বরং বেগম জিয়াকে গ্রেপ্তার না করে বিদেশে পাঠানোর পক্ষে মত দেন। বিএনপির নেতারা তাঁদের প্রধানকে বেশি ভয় পেতো বলেও মঈন ইউ আহমেদ পাণ্ডুলিপিতে মন্তব্য করেছেন। তিনি পাণ্ডুলিপিতে লিখেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করল, তখন আওয়ামী লীগের নেতারা নেতৃত্ব এবং ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। চারজন নেতা পৃথক ভাবে গোয়েন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের প্রধানমন্ত্রী পদের যোগ্য বলে দাবি করেন। এরা এক পর্যায়ে বিরক্তি এবং রসিকতার বস্তুতে পরিণত হন। এরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে, আমাকে নেতা হবার প্রস্তাব দেয়। একই প্রস্তাব আসে বিএনপি থেকেও। আওয়ামী লীগ বিএনপি সব ব্যাপারে ঝগড়া করলেও আমি দেখেছি, তাদের ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে কোনো বিরোধ ছিল না। দুপক্ষ থেকেই সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু সর্বদলীয় সরকার প্রধান কে হবে, এই প্রশ্ন করলে দুদল থেকেই আমার নাম আসে। কিন্তু আমি ওই প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করি। অবশ্য সুশীল সমাজ সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেখায়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী সেনা গোয়েন্দাদের দল একদিন আমার সঙ্গে বৈঠক করে। পুরো রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে তারা আমাকে জানায়, ‘একমাত্র শেখ হাসিনা ছাড়া সব রাজনীতিবিদকেই কেনা যায়।’পরে তাঁদের কথার সত্যতা আমি হারে হারে টের পাই। তিনি লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক সংস্কারের ব্যাপারে হাত না দিলে আমরা বুঝতাম না, আমাদের রাজনৈতিক সমস্যা কোথায়। অচিরেই আমরা বুঝি, সমস্যা দুই নেত্রী নন, সমস্যা নেতারা। তারা শুধু কিছু পাবার চিন্তায় বিভোর থাকেন। এদের কাছে আদর্শ মূল্যহীন।