অপরাধ বিচিত্রা রিপোর্ট | নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেয়ার বিধান সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রধান বিচারপতির এই পর্যবেক্ষণ এসেছে।
গত ৩ জুলাই সাত বিচারকের আপিল বিভাগের দেয়া ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি মঙ্গলবার প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট।
৭৯৯ পৃষ্ঠার এই রায়ে নিজের পর্যবেক্ষণ জানাতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অধস্তন আদালতকেও স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে ‘সুপ্রিম কোর্ট’ শব্দটি ‘রাষ্ট্রপতি’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়, যেটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং স্বাধীন বিচার বিভাগের পরিপন্থি।
আপিল বেঞ্চের সাত বিচারকের মধ্যে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার প্রধান বিচারপতির ওই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করলেও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী সহমত প্রকাশে ‘অক্ষমতা’ প্রকাশ করেছেন।
আর এই মামলা প্রাসঙ্গিক নয় বিবেচনা করে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি ইমান আলী ১১৬ অনুচ্ছেদের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন।
১৯৭২ সালে দেশের প্রথম সংবিধানের ১১৬ ধারায় বলা ছিল, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
বঙ্গবন্ধুর সময় ১৯৭৪ সালে চতুর্থ সংশোধনীতে ওই ১১৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আসে। সেখানে বলা হয়, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সেটা প্রযুক্ত হবে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনে। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদে বাহাত্তরের বিধান আর ফেরেনি।
অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলির ক্ষমতা এককভাবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে না থাকায় ‘দ্বৈত শাসন’ সৃষ্টি হচ্ছে মন্তব্য করে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল করে ১৯৭২-এর সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ ফেরানোর কথা বলে আসছেন প্রধান বিচারপতি। ওই অনুচ্ছেদকে বিচার বিভাগের কাজের ধীরগতির অন্যতম কারণ হিসেবেও এর আগে চিহ্নিত করেছেন তিনি।
ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে রায়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণে ১১৬ অনুচ্ছেদের ওই পরিবর্তনকে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে ‘সরাসরি সাংঘর্ষিক’ বলা হয়েছে।
সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে অধঃস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হাইকোর্টের হাতে দেয়া হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি তার লেখা রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ শৃঙ্খলাবিধানের ক্ষমতা যদি না থাকে, তাহলে অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের ওপর হাইকোর্টের নিয়ন্ত্রণ কীভাবে সম্ভব তা বোধগম্য নয়।
আপিল বিভাগে এই মামলার শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির শাসনামলে তখনকার প্রেক্ষাপটে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটি আনা হয়েছিল।
‘এই ব্যাখ্যাটি খুবই সেকেলে, কারণ সরকার গঠনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই; এটি স্বাধীন বিচার বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত,’ বলেছেন প্রধান বিচারপতি।
তার পর্যবেক্ষণে বলা হয়, অধস্তন বিচার বিভাগের সঙ্গে জনগণের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে, তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নটি সেখানে কোনোভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অধস্তন আদালতকে অবশ্যই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে।
‘কিন্তু বিচার বিভাগকে এখনো যে হতাশাজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তা হলো, মাসদার হোসেন মামলার নির্দেশনার পরও সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ (রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ) কার্যকর করার ক্ষেত্রে কিছুই করা হচ্ছে না।
অ্যাটর্নি জেনারেল এটা বুঝতে পারছেন না যে, চতুর্থ সংশোধনীর আগে সমস্ত আদালত ও ট্রাইব্যুনালের নিয়ন্ত্রণ ছিল হাইকোর্ট বিভাগের হাতে, যার মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হতো।’
প্রধান বিচারপতির এই পর্যবেক্ষণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি রায়ের এক জায়গায় অনুচ্ছেদ ১১৬ সম্পর্কে বলেছেন, এটা সংবিধান পরিপন্থি। কিন্তু রায়ের শেষাংশে যেখানে সবাই একমত হয়েছেন, সেখানে এটা পেলাম না।
রায়ের ভেতর যাই বলা থাকুক না কেন, রায়ের সমাপনীতে যেটা বলা আছে সেটি দেখতে হবে। অর্ডার অব দ্য কোর্ট কোনটা, সেখানে কিন্তু ১১৬ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি।’
রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা বলেন, ১১৬ সাংঘর্ষিক বলে একজন বিচারকের অভিমত রায়ে এসেছে। কিন্তু ‘অর্ডার অব দ্য কোর্ট’ অংশে তা না আসায় ‘১১৬ বাতিল হয়েছে’ বলা যায় না।
‘১১৬ অনুচ্ছেদকে বাতিল করতে হলে সবাইকে সেখানে সই করতে হতো। অর্ডার অব দ্য কোর্টে তা নেই।’