স্বাস্থ্যখাতে মিঠু সিন্ডিকেটের জাল বিস্তার যেভাবে

0
1843

বহুল আলোচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু সিন্ডিকেট এখন বলতে গেলে গোটা স্বাস্থ্যখাতে জাল বিস্তার করে আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিএমএসডি ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমুহে মিঠু তার এজেন্ট নিয়োগ করেছে। এসব এজেন্টরাই মিঠুর হয়ে কাজ করে। কখনো উপরের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রভাব খাটানো হয়, কখনো অর্থের লেনদেনে ম্যানেজ করা হয়, আবার তাতে কাজ না হলে হুমকি-ধমকি দিয়ে কাজ আদায় করা হয়। এই সিন্ডিকেটের মর্জিমতো কাজ না করে উপায় নেই, বলছিলেন গুরুত্বপূর্ণ একটি সরকারি হাসপাতালের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা। কারণ, এই সিন্ডিকেটের লুটপাটসহ নানান রকমের অবৈধ কর্মকা-ের সঙ্গে মন্ত্রীর পরিবারের সদস্যের যোগসাজশ রয়েছে। যেভাবে টেন্ডার কারসাজি চলে শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটে রয়েছে সরকারি সিনিয়র পর্যায়ের ডাক্তার, প্রশাসনের কর্মকর্তা, কর্মচারী ছাড়াও বাইরের কিছু দালাল। এরা সরকারি যে হাসপাতাল বা যে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে সেই হাসপাতালের প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে আগেই বোঝাপড়া করে নেয়। টেন্ডার যেভাবেই আহ্বান করা হোক, যে বা যারাই টেন্ডারে অংশ নিক না কেন কাজ তাদেরই দিতে হবে। ওই স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কোনো যন্ত্রপাতির প্রয়োজন না থাকলেও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের চাহিদা তৈরি করা হয়। যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের বরাদ্দ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তারাই এনে দেয়ার ব্যবস্থা করে। এরপরেই শুরু হয় টেন্ডার কারসাজি। টেন্ডার ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে সিন্ডিকেটের প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়ার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয় টেন্ডার সিডিউল তৈরি করার সময়ই। সিন্ডিকেটের বিশেষ প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কেউ যাতে টেন্ডারে অংশ নিতে না পারে সেভাবেই স্পেসিফিকেশন তৈরি করা হয়। সিন্ডিকেটের প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কেউ টেন্ডারে অংশ নিলেও সেগুলোকে নানান অজুহাতে নন-রেসপন্সিভ করা হয়। এভাবেই কমমূল্যের যন্ত্রপাতি বেশি মূল্যে বা অস্বাভাবিক মূল্যে সরবরাহের কার্যাদেশ আদায় করে নেয় সিন্ডিকেটের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু, তাতেও এরা ক্ষান্ত হয় না। এক দেশের তৈরিকৃত মালামাল সরবরাহের কথা বলে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আরেক দেশের তৈরি করা কমমূল্যের ও নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ করে থাকে। দেখা যায়, ইউরোপ-আমেরিকার মালামালের কথা বলে চীন বা ভারতের মালামাল সরবরাহ করা হয়। যেহেতু সর্বত্রই সিন্ডিকেটের লোকজন নিয়োজিত থাকে তাই এসব জাল-জালিয়াতি কোথাও বাধা পায় না। আর এভাবেই হাতিয়ে নেয়া হয় সরকারের শ’ শ’ কোটি টাকা। মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য যারা ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার শুরু থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান স্বাচিপ নেতা আফম রুহুল হক। আর এই বহুল আলোচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর হঠাৎ অস্বাভাবিক উত্থান ঘটে রুহুল হকের হাত ধরেই। এক পর্যায়ে রুহুল হক এবং তার ছেলে এই মিঠুর অঘোষিত বিজনেস পার্টনার হিসেবে আখ্যায়িত হন। মিঠু সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশ ও লাগামহীন দুর্নীতির কারণে ২০১৩ সালের শেষে নির্বাচনকালীন সরকারের সময় রুহুল হককে মন্ত্রীপদ থেকে বাদ দেয়া হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান মোহাম্মদ নাসিম। মোহাম্মদ নাসিম মন্ত্রীপদে বসেই যে কোনো ধরনের সিন্ডিকেটকে এড়িয়ে চলার ঘোষণা দেন। এ সময় কিছুটা বেকায়দায় পড়েন মিঠু। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সবকিছু আগের মতো ঠিকঠাক করে ফেলেন। মন্ত্রীর পরিবারের সদস্যকে সিন্ডিকেটের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে আবারো পুরো স্বাস্থ্যখাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবির্ভূত হন। এসময় স্বাস্থ্যসচিব পদে ছিলেন নিয়াজউদ্দিন মিয়া। এরপর স্বাস্থ্যসচিব হয়ে আসেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। এই দুই সচিবও মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) পদে থাকাকালে ডা. এবিএম আবদুল হান্নান এবং তার পরের পরিচালক (হাসপাতাল) ড. সামিউল ইসলাম সাদীও মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে যান। এরা মিঠুকে শত শত কোটি টাকা লুটপাটে সহযোগিতা করেন। সূত্রমতে, মন্ত্রী-সচিবসহ স্বাস্থ্যখাতের উপরের প্রশাসনিক পদগুলোতে যখন যিনি আসেন তিনিই মিঠুর সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে যান। এছাড়া নিচের পর্যায়ে স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন পদে মিঠু সিন্ডিকেটের কিছু পারমানেন্ট সদস্যও আছে। নিচের পর্যায়ের পদ হলেও এরা প্রত্যেকেই মিঠুর বদৌলতে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী বলে পরিচিত। মিঠু সিন্ডিকেটের পারমানেন্ট সদস্য হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত আছেন সহকারী সচিব সুলতান মাহমুদ। তিনি ইতিপূর্বে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ছিলেন। সহকারী সচিব পদে পদোন্নতির পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখায় একই পদ দখল করে রেখেছেন। সুলতান মাহমুদ হাসপাতাল অথবা প্রশাসন এই দুটো শাখায়ই অদল-বদল করে আছেন। তাকে অন্য কোথাও বদলি করা যায় না মিঠুর কারণে। মন্ত্রণালয়ে মিঠুর হয়ে খুঁটিনাটি কাজগুলো সব সুলতান মাহমুদ করে থাকেন। জানা গেছে, সুলতান মাহমুদ ছাড়াও মিঠুর এই সিন্ডিকেটে বর্তমানে আছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আফজাল হোসেন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের প্রধান সহকারী দেলোয়ার হোসেন, মুগদা জেনারেল হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহয়েল কাফি, খুলনাস্থ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা অহেদুজ্জামান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের উচ্চমান সহকারী আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। এরা মাঝেমধ্যেই মিঠুর অফিসে আসেন এবং সেখানে বসে পরিকল্পনা করেন কীভাবে, স্বাস্থ্য খাতের কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করা যাবে এসব নিয়ে। দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে সিন্ডিকেটের অন্তর্ভুক্ত করেন। কেউ তাদের কথা না শুনতে চাইলে বা অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ হতে না চাইলে তাকে ওএসডি অথবা বদলির ভয় দেখান। জানা গেছে, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আফজাল হোসেনের চাকরি স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক মেডিকেল এডুকেশনের দফতরে। কিন্তু, তিনি পুরো অধিদফতরের উপর কর্তৃত্ব খাটান। মিঠুর পক্ষে অধিদফতরের কাজগুলো তিনিই করেন। বসেন হিসাব রক্ষণ শাখায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আফজাল হোসেনের চাকরিই মূলত বৈধ নয়। এ কারণে তিনি বেতন পান না। অবশ্য, বেতনের তার প্রয়োজনও নেই। সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে অবৈধ উপায়ে ইতিমধ্যে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু সিন্ডিকেটের আরেকজন অন্যতম সদস্য দেলোয়ার হোসেন। তিনি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের প্রধান সহকারী পদে থাকলেও সেখান থেকে পুরো স্বাস্থ্যখাতে প্রভাব খাটান। ইতিমধ্যে দেলোয়ার হোসেন স্বাস্থ্যখাতের কর্মচারীদের সংগঠন- অফিস সহকারী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদকও হয়েছেন। মিঠুই তাকে এই পদে আসতে সাহায্য করেছেন। অহেদুজ্জামান কর্মরত আছেন খুলনাস্থ আধুনিক শেখ আবু নাসের হাসপাতালে। এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকা হলে চলতো, অথচ এখানে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হয়েছে লুটপাটের সুবিধার জন্য। অহেদুজ্জামান শুধু শেখ আবু নাসের হাসপাতালই নয়, মিঠুর হয়ে পুরো খুলনা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন। আব্দুল্লাহয়েল কাফি ছিলেন বগুড়ায়, সেখান থেকে রাজশাহী-নোয়াখালী হয়ে ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতালে আসেন। কাফিকে মিঠু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠান লুটপাটের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেওয়ার জন্য। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ, গাজীপুর, রংপুর, দিনাজপুরসহ সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকল সরকারি হাসপাতালেই মিঠু সিন্ডিকেটের প্রচ- দৌরাত্ম রয়েছে। এসব জায়গায় মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনার নামে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে শ’ শ’ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।

Advertisement
Advertisement

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here