চেয়ারম্যানকে ফাঁসানোর অভিযোগ বিজিবির বিরুদ্ধে অতঃপর অবরুদ্ধের ঘটনা
মুহম্মদ তরিকুল ইসলাম, পঞ্চগড় প্রতিনিধিঃ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মসলিম উদ্দিনকে ফেনসিডিল দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে বিজিবি’র বিরুদ্ধে। জল্পনা কল্পনায় ১০৭ বোতল ফেনসিডিল চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে উদ্ধারের পর তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় পঞ্চগড় ১৮ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)’র ভুতিপুকুর বিওপি’র সদস্য, তেঁতুলিয়া মডেল থানা পুলিশ সদস্য ও তাদের গাড়িগুলো স্থানীয় হাজারো মানুষ অবরুদ্ধ করে রাখেন। গত শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) দুপুরে ভজনপুর ইউনিয়নের ভুতিপুকুর সীমান্তের ভাঙ্গীপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় লোকজন ও ইউপি চেয়ারম্যানের পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য মতে জানা যায়, ‘শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে বাড়িতে বসে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান মসলিম উদ্দিন। এ সময় প্রথমে বিজিবি দুজন সদস্য এসে ইউপি চেয়ারম্যানকে বলেন, আপনার সঙ্গে কথা আছে, লোকজনকে চলে যেতে বলেন। স্থানীয় লোকজন চলে যাওয়ার পরপরই অন্তত পাঁচটি গাড়িতে ৩০ থেকে ৪০ জন বিজিবি সদস্য বাড়িতে আসেন। এরপর তাঁরা পরিবারের সবার মুঠোফোনগুলো নিয়ে নেন। পরে চেয়ারম্যানসহ সবাইকে ঘর থেকে সরে যেতে বলেন। এর কিছুক্ষণ পর বিজিবি সদস্যরা আবারও সবাইকে ডেকে ঘরে তল্লাশি চালানোর কথা বলেন। পরে মসলিম উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিটি ঘর তল্লাশি করেন বিজিবির সদস্যরা। শেষে মসলিম উদ্দিনের ঘরে গিয়ে বিজিবি সদস্যরা দুটি সাদা রঙের মোড়ানো বস্তা দেখিয়ে কী রয়েছে জানতে চান। পরে বস্তা দুটি খুলে দেখা যায় সেখানে ১০৭ বোতল ফেনসিডিল। তখন ফেনসিডিলসহ চেয়ারম্যান মসলিম উদ্দিনকে পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে যান বিজিবির সদস্যরা। এরই মধ্যে চেয়ারম্যানকে মাদক দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ তুলে এলাকাবাসি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চেয়ারম্যানকে আটকের খবর ছড়িয়ে পড়লে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে স্থানীয় লোকজন বিজিবি ও পুলিশের গাড়ির গতিরোধ করে আটকে দেন। ধীরে ধীরে ওই এলাকায় লোকজন বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে হাজারো মানুষ বিজিবি, পুলিশ সদস্যদের গাড়িসহ অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ ছাড়া এই খবর ছড়িয়ে পড়লে বেলা দুইটার দিকে ভজনপুর বাজারেও পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়ক অবরোধ করেন বিক্ষুব্ধ লোকজন।
খবর পেয়ে পঞ্চগড় ১৮ বিজিবির অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল জিয়াউল হক, তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে রাব্বী, তেঁতুলিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রবীর চন্দ্র সরকার, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শাহাদৎ হোসেন রঞ্জু, সদস্য সচিব রেজাউল করিম শাহীন সহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সেখানে যান। স্থানীয়দের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর তদন্ত পূর্বক এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। বিজিবি সদস্যরা পরে ইউপি চেয়ারম্যানকে ছেড়ে দিয়ে জব্দ করা ফেনসিডিল নিয়ে যান।
চেয়ারম্যানের প্রতিবেশীগণ জানান, ইউপি চেয়ারম্যানকে মাদকের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের চেয়ারম্যান মাদক তো দূরের কথা ধূমপানও করেন না। ইউপি চেয়ারম্যানের মানহানিকর এমন ঘটনায় আমরা মর্মাহত। আমরা দোষীদের বিচার চাই।
চেয়ারম্যান মসলিম উদ্দিন বলেন, তিন দিন আগে আমার পরিষদের কয়েকজন সদস্য তিনটি ভারতীয় গরু আটক করেন। ভুতিপুকুর বিজিবির সদস্যরা গরু তিনটিকে চাইলে আমরা সেগুলো খোয়াড়ে দিই। যেহেতু সেগুলো জনপ্রতিধিরা আটক করেছেন, তাই গরুগুলোর মালিক বের হয় কিনা জানার জন্য কয়েকদিন খোয়াড়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ নিয়ে ১৮ বিজিবির সহকারী পরিচালক জামাল উদ্দিনের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়। শুক্রবার বেলা ১১টার পর হঠাৎ বিজিবি আমার বাড়ি ঘেরাও করে। ঘরে প্রবেশ করে আমাকে বলে আপনার ঘরে ফেনসিডিল আছে। একটি বস্তা দেখিয়ে বলে এই বস্তায় ফেনসিডিল আছে। পরে আমাকে বিজিবির গাড়িতে উঠতে বলে তারা। গাড়িতে উঠতে শুরু করলে শত শত গ্রামবাসী আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনেন। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচারের দাবি করছি। যাতে আর কাউকে ফাঁসানোর চেষ্টা না করা হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পঞ্চগড় ১৮ বিজিবির সহকারী পরিচালক জামাল উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, অস্ত্র ও ফেনসিডিল আছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে ১৮ বিজিবির টুআইসি মেজর রিয়াদ মোর্শেদসহ বিজিবির সদস্যরা চেয়ারম্যানের বাড়িতে অভিযানে যান। আমার সঙ্গে চেয়ারম্যানের কোনও বিরোধ নেই। গরু নিয়ে বিজিবির সঙ্গে কোনও ঘটনা ঘটেনি। চেয়ারম্যানের বাড়িতে ১০৭ বোতল ফেনসিডিল পাওয়া গেছে। তাকে আটক করলে স্থানীয়রা ব্যারিকেড দেয়। যেহেতু গ্রামবাসী তার পক্ষে তাই আমরা মামলা করছি না। জব্দকৃত ফেনসিডিল থানায় জমা দেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে রাব্বী বলেন, মহাসড়ক অবরোধের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারেন, ভজনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে ফেনসিডিল উদ্ধার ও তাঁকে আটকের ঘটনায় এমন পরিস্থিতির সুষ্টি হয়েছে। পরে ১৮ বিজিবির সিও এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তায় পরিস্থিতি শান্ত করা হয়। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তদন্ত করা হবে।
এ বিষয়ে পঞ্চগড় ১৮ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল জিয়াউল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং (ভুল–বোঝাবুঝি) হতে পারে। তবে সীমান্ত এলাকায় বিজিবির নিয়মিত চোরাচালান দমন অভিযানের অংশ হিসেবে ওই বাড়িতে তল্লাশী করা হয়েছে। এটা হয়তো যারা আমাদের তথ্য দিয়েছে, সেটাতে তাঁকে ফাঁসানোর জন্য বা তাঁর সঙ্গে কারও শত্রুতা আছে, এমনটাও ঘটতে পারে। তবে এটা সত্য যে সেখানে ফেনিসিডিলি পাওয়া গেছে।’ জিয়াউল হক আরও বলেন, উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতে বিক্ষুব্ধ জনতাকে থামাতে চেয়ারম্যানকে আটক করা হয়নি। এমনকি এ ঘটনায় কোনো মামলাও হয়নি। তবে উদ্ধার করা ফেনসিডিলগুলো থানায় জমা দেওয়া হবে। এ ছাড়া বিষয়টি তদন্ত করা হবে।