হযরত ইব্রাহিম আ: এর জীবনী: (৩নং পর্ব)

দ্বীনের দাওয়াতে সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে বিতর্ক:
আযর যখন কোন অবস্থায়ই তাঁর পুত্রের উপদেশ ও দাওয়াত গ্রহণ করল না তখন হযরত ইবরাহীম (আ) পিতা আযরকে পরিত্যাগ করে তাঁর দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ আরও সম্প্রসারিত করলেন। হযরত ইবরাহীম (আ) সমস্ত সম্প্রদায়কে সামনে রেখে দাওয়াত দেয়া আরম্ভ করলেন। কিন্তু গোত্রের লোকেরা, কোন অবস্থায় তাদের পিতৃ পুরুষের ধর্মমত পরিত্যাগ করতে রাজি নয়। তারা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর আহবানের প্রতি কর্ণপাত করতেই রাজি নয় বরং হকের দাওয়াতের সামনে নিজেদের বাতিল পূজ্যদের ন্যায় মুক, বধির ও অন্ধ হয়ে রইল। কুরআনের ভাষায়-
ولَهُمْ أَعْيُنٌ لا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَذَانٌ لَا يَسْمَعُونَ بِهَا أولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَصَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَفِلُونَ .
উচ্চারণঃ অলাহুম আ’ইয়নুল লা-ইয়ুবছিরূনা বিহা, অলাহুম আ-যা-নুল্লা-ইয়াস্মাউনা বিহা-উলা-য়িকা কাল আন’আ-মি বাল হুম আদ্বোয়ালু, উলা-য়িকা হুমুল গা-ফিলুন।
অর্থঃ “তাদের অন্তর আছে কিন্তু অনুধাবন করে না। তাদের চোখ আছে কিন্তু দেখে না। তাদের কান আছে শুনে না। তারা তো চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়। বরং তারা এ অপেক্ষাও অধিক
পথভ্রষ্ট, তারাই অসতর্ক।” (সূরা-আরাফঃআয়াত- ১৭৯)
যখন হযরত ইবরাহীম (আ) খুব জোর দিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা বল তো দেখি তোমরা যাদের পূজা কর তারা কি তোমাদের কোন উপকার বা অপকার করতে পারে? তারা বলে, আমরা এ সব বিতর্কে জড়াতে চাই না। আমরা শুধু এটুকু জানি যে, আমাদের পূর্বপুরুষরা এদের উপাসনা করে আসছে আমরাও তাই করছি। অতঃপর হযরত ইবরাহীম (আ) এক বিশেষ পন্থায় তাদেরকে আল্লাহর দিকে মনোযোগ আকর্ষন করতে চেষ্টা করেন। কুরআনের ভাষায়-
উচ্চারণঃ ইয় কা-লা লি আবীহি অক্বাওমিহী মা-তা’বুদূনা। ক্বা-লু না’বুদু আছ না মানু ফানাযায়াল্লু লাহা-‘আ কিফীনা। ক্বা-লা হাল ইয়াসমাউ’নাকুম্ ইয়াদউ’না। আওইয়ান ফাউ’নাকুম্ আওইয়ানছুরন্ধনা। কা-লু বাল অজ্বাদানা-আ-বা আনা কাযা-লিকা ইয়াফ’আলুনা। জ্বালা আফারা আইতুম মা-কুনতুম তা’বুদুনা। আনতুম অআবা-উকুমুল্ আবুদামুনা। ফাইন্নাহুম ‘আদুও উল্লী ইল্লা রব্বাল ‘আ-লামীন।
অর্থঃ “যখন (ইবরাহীম (আ)) স্বীয় পিতা ও আপন কওমের লোকদেরকে লক্ষ্য করে বলেন, তোমরা কি জিনিসের পূজা করছ? তারা বলল, আমরা প্রতিমার পূজা করছি। আর এদের অরাধনায় একনিষ্ট বললেন, যখন তোমরা এদেরকে ডাক তখন কি এরা তোমাদের কথা শুনতে পায়? অথবা এরা তোমাদের কোন উপকার করতে পারে? অথবা কি তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারে? তারা বলল, বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে এরূপ অবস্থায় পেয়েছি হযরত ইবরাহীম (আ) বলেন, ঠিক আছে। তোমরা এবং তোমাদের পূর্ব পুরুষরা যাদের ইবাদত করছে ওদের অবস্থার প্রতি কি তোমরা কোন চিন্তা করে দেখেছ যে, এ সব বাতিল উপাস্যসমূহ আমার শত্রু কিন্তু বিশ্বনিখিলের রব আমার ও তোমাদের শত্রু নয়।
(সূরা- শুয়ারাঃ আয়াত-৭৬-৭৭)
তাই মহান রব আল্লাহ্ পাক উপাসনা পাওয়ার একমাত্র হকদার। তাঁকে ছাড়া অন্য ইলাহ মানা ক্ষতির কারণ বরং তোমাদের ধ্বংস ডেকে আনবে। শত্রুর কাজ হল ক্ষতি করা। এদের পূজা অর্চনা যেহেতু ক্ষতির কারণ সুতরাং এরা আমার, তোমাদের শত্রু। কিন্তু আমি মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও রব আল্লাহর উপাসনা করতে তোমাদের আহবান করছি। অতঃপর হযরত ইবরাহীম (আ) মহান আল্লাহর কতক গুণাবলীর কথা গোত্রের লোকদের সামনে তুলে ধরে তাদেরকে এ কথা বুঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, উপাসনা পাওয়ার যোগ্য একমাত্র ঐ মহান সত্তা যার সাথে এ সকল গুণ রয়েছে। আর তোমরা নিজের হাতে গড়া যে সব প্রতিমার উপাসনা করছ এরা তো এ সকল গুণের অধিকারী নয়। সুতরাং কেমন করে এরা তোমাদের উপাসনা পাওয়ার যোগ্য হতে পারে? কোরআনের ভাষায়-
উচ্চারণ: আল্লা-যী খালাক্বানী ফাহুয়া ইয়াহদীনি। অল্লাযী হয়া ইযুত্বই ‘মুনী অইয়াস কীনি। অইযা মারিদ্বতু ফাহুয়া ইয়াস্ফীনি। অল্লাযী ইয়ুমীতুনী ছুম্মা ইয়হয়িনি। অল্লাযী আত্বমাউ’ আইইয়াগফিরলী খাত্বীয়াতী ইয়াওমাদ্দীনি।
অর্থঃ “তিনিই আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনিই আমাকে পথ দেখিয়েছেন আর তিনিই পানাহার করাচ্ছেন। অসুস্থ হলে তিনিই আরোগ্য করেন। তিনিই আমার মৃত্যু দেন আবার জীবিত করবেন। আর তিনি এমন এক সত্তা যাঁর কাছে আশা রাখি যে, হিসাব নিকাশের দিনে আমার গুনাহ ক্ষমা করবেন। (সূরা-শুয়ারঃ আয়াত-৭৮-৮২)
ইবরাহীম (আ) বলেন, হে আমার জাতির লোকসকল! তোমরা সে সত্তার ইবাদত কর
যিনি তোমাদের স্রষ্টা, পালনকর্তা, প্রতিপালক। প্রতিমা পূজা পরিত্যাগ কর। কেননা, প্রতিমা
পূজায় কোন কল্যাণ নেই। প্রতিমাগুলো তোমাদের লাভ ক্ষতি কিছুই করতে পারে না। ইবরাহীম (আ)-এর যৌক্তিক বক্তব্যের বিপরিতে তারা যখন কোন দলিল পেশ করত সমর্থ হল না তখন তাঁকে হত্যার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কোরআনের ভাষায়-
উচ্চারণ: কা-লু হাররিকুহু ওয়ানছুরু আ-লিহাতাকুম, ইন কুনতুম ফা-ই’লীন।
অর্থঃ তারা বলল, তোমরা একে জ্বালিয়ে ফেল এবং নিজেদের উপাস্য দেবতাদেরকে সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু একটা করার মত হও। নমরূদ বলল-
উচ্চারণঃ কা-লুবনু লাহু বুনইয়া-নান ফাআলকুহু ফিলজাহীম।
অর্থঃ তারা বলল, তার জন্য একটি অট্টালিকা নির্মাণ কর, অতঃপর তাকে অগ্নিকুণ্ডে
-নিক্ষেপ কর।
- হযরত ইব্রাহীম (আ)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপের কাহিনী
বদশাহ নমরূদের নির্দেশের সাথে সাথে অগ্নিকুণ্ড নির্মাণ ও প্রজ্জ্বলিত করার আয়োজন শুরু হল। এক বিশালাকৃতির খোলা ময়দানে যমীন খুঁড়ে বিরাট আয়তন বিশিষ্ট একটি গভীর গর্ত তৈরি করা হল। পাহাড় হতে রাশি রাশি কাষ্ঠ এনে এ গর্তে সাজান হল। অতঃপর হাজার হাজার মণ তৈল ঢেলে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হল। এ প্রকাণ্ড অগ্নিকুণ্ডের আগুনের তাপে চারিপার্শ্বে বহুদুর এলাকা পর্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে গেল।
কথিত আছে যে, উক্ত অগ্নিকুণ্ডের দৈর্ঘ প্রস্থ ছিল চব্বিশ মাইল করে এবং তার গভীরতা ছিল একশত গজ। দাউ দাউ করে জলন্ত আগুনের শিখা এতদূর উঁচু হয়ে উঠল যে আকাশের দিকে অন্ততঃ অর্ধমাইল পর্যন্ত উড্ডয়নরত পাখিসমূও তার তাপে মারা গিয়ে ভূমিতে নিক্ষিপ্ত হতে লাগল। তখন সকলে চিন্তিত হয়ে পড়ল। কিভাবে অগ্নিকুণ্ডের নিকটবর্তী হয়ে হযরত ইবরাহীম (আ)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা যাবে?
/এ অবস্থায় সকলে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। অভিশপ্ত ইবলীস সর্বব্যপারে অবস্থান করে লক্ষ্য রেখেছিল। সে দেখল যে তার অনুসারী শিষ্যরা এক জঠিল সমস্যায় পতিত হয়েছে এ পর্যন্ত তারা তারই নির্দেশিত পথে বেশ সুন্দরভাবে অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু সহসা এক প্রতিবন্ধকতায় তাদের গতি থেমে যায়। সে নিজেই এ প্রতিবন্ধকতাকে অপসারণ করার লক্ষ্যে সাধু দরবেশের বেশে নমরূদের আমলাদের কাছে উপস্থিত হল এবং তাদেরকে বিরাট একটি চরখ গাছ স্থাপন করার পরামর্শ দিয়ে বলল উক্ত চরখ গাছের সাহায্যে ইবরাহীমকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ কর।
✓✓ অভিশপ্ত ইবলীসের পরামর্শানুযায়ী বিরাট একটি চরখ গাছ তৈরি করে এর একপ্রান্তে হযরত ইবরাহীম (আ)-কে বেধে সকলে মিলে তার অপরপ্রান্ত ধরে শূন্যে উত্তোলন করতে চেষ্টা করল; কিন্তু কোনক্রমেই তারা উক্ত চরখ গাছের অপরপ্রান্ত শূন্যে উত্তোলন করতে পারল না। সকলেই চিন্তিত হল, এখন কিভাবে কার্য সমাধা করা যায়।
এমন সময় অভিশপ্ত ইবলীস এসে বলল, তোমরা সমগ্র জগতের মানুষ সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলেও হযরত ইবরাহীম (আ)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করতে পারবে না। কেননা, সত্তর হাজার ফেরেশতা চরখ গাছের একপ্রান্ত চেপে ধরেছে। তোমরা যদি এখানে প্রকাশ্যভাবে চল্লিশজন পুরুষের সাথে চল্লিশজন অপরিচিতা রমণীর মিলন করতে পার তবে ফেরেশতারা এখান হতে চলে যাবে। তখন তোমরা অতি সহজেই ইবরাহীম (আ) কে শূন্যে তুলে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করতে পারবে।
✓ ইবলীসের এ জঘন্য কু-পরামর্শানুযায়ী অগণিত লোকের সম্মুখে প্রকাশ্যে সে ভাবে চল্লিশজন পুরুষের সাথে চল্লিশজন রমণীর মিলন ঘটান হল। এ জঘন্য অপকর্ম সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে পূণ্যবান ফেরেশতার সেখান হতে চলে গেল। আর এ সুযোগে নমরূদের কর্মচারীবা চরখ গাছ শূন্যে উত্তোলন করে হযরত ইবরাহীম (আ)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করল।
✓ কথিত আছে যে, কাফিররা যখন ইবরাহীম (আ)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হয়েছিল তখন এদের সাথে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর মূর্তিপূজক পিতা আজরও শামিল ছিল। কেননা, সেও তার পুত্রের উপরে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিল।
এ দৃশ্য দেখে হযরত ইবরাহীম (আ) আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন, হে আমার রব। আজ আমার প্রাণ হনন কার্যে স্বযং আমার জনাদাতা পিতা পর্যন্ত শরীক হয়েছে, সুতরাং আমাকে সাহায্য করার আজ আপনি ব্যতীত আর কেউ নেই।
বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর প্রিয় দোস্ত ইবরাহীম (আ) যখন কাফেরদের দ্বারা উত্তোলিত চরখ গাছ হত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হলেন, ঠিক সে মুহূর্তে আল্লাহর নির্দেশে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হল, যেন ফেরেশতারা আল্লাহর বন্ধুর এ চরম সঙ্কটকে প্রত্যক্ষ করে তাঁর জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে পারে। সত্যই এ লোমহর্ষক হৃদয়বিদারী দৃশ্য দেখে আসমানের সকল ফেরেশতা শিহরে উঠে এবং সকলে মিলে আল্লাহর দরবারে আকুল আবেদন জানালেন হে মাবুদ। তুমি হযরত ইবরাহীম (আ) কে নমরূদের জ্বলন্ত আগুন হতে রক্ষা কর।
আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁদের দোয়া কবুল করে এবং জিবরাইল (আ) কে বলেন, হে জিবরাইল। তুমি ফেরেশতাদেরকে নিয়ে আমার খলীলের কাছে গিয়ে তাঁর নিকট জিজ্ঞেস কর সে তোমার নিকট হতে কি সাহায্য চায়। জিবরাইল চোখের পলকে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর নিকট এসে বলেন, হে আল্লাহর খলীল। আপনি হুকুম করলে আমি ফেরেশতাদের নিয়ে আমাদের ডানার আঘাতে নমরুদের এ অগ্নিকুণ্ডকে এ মুহূর্তে সপ্ত সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে পারি।
হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হে জিবরাইল। এটা কি আল্লাহর ইচ্ছা, না আপনি নিজ থেকে বলছেন। জিবরাইল বললেন, এটা আল্লাহ্ আমাকে বলেন নি, তবে আমি নিজ থেকে বলছি। হযরত ইবরাহীম (আ) বললেন, ভাই জিব্রাইল! আপনাকে আল্লাহ্ যা বলেছেন, আপনার শুধু তাই করা কর্তব্য-অন্য কিছু নয়। জিবরাইল বলেন, তবে আপনি বলুন, আপনি সঙ্কটজনক মূহূর্তে কি সাহায্য পেতে চান? হযরত ইবরাহীম (আ) বলেন, আমি আপনার নিকট কোন সাহায্য চাইনা। আমি সাহায্য কামনা করি সে মহান মালিক আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নিকট। হযরত ইবরাহীম (আ)-এর জবাবে জিব্রাইল নীরব হয়ে গেলন। এদিকে হযরত ইবরাহীম (আ) এতক্ষণে আগুনের প্রায় নিকটবর্তী হয়ে গিয়েছেন, এখন কেবলমাত্র পরস্পরের স্পর্শ হওয়াটুকু বাকী। কিন্তু ঠিক শেষ মুহূর্তে আল্লাহ পাক বজ্র নির্ঘোষে আওয়াজে বলেন :
উচ্চারণঃ ইয়া-না-রু কুনী বারদাওঁ ওয়া সালা মান ‘আলা ইবরাহীম, ওয়া আরাদু বিহী কাইদার ফাজা আলনাহুমুল আখসারীন।
✓ অর্থঃ অগ্নি! তুমি ইবরাহীমের উপর শান্তিদায়ক হয়ে যাও। আর যারা তাঁর অকল্যাণ কামনা করছিল, তাদেরকেই আমি খারাপ অবস্থায় নিপতিত করেছি।
হযরত ইবরাহীম (আ) যখন অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হল তখন আল্লাহ তাআলা সেখানে পনির একটি ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করেন। জিবরাঈল (আ) জান্নাতী পোশাক এনে তাঁকে পরিয়ে তখতের উপর বসিয়ে দেন। যে রশি দিয়ে হযরত ইবরাহীম (আ) এর হাত-পা বাঁধা হয়েছিল তা পুড়ে যায় অথচ ইবরাহীম (আ) এর কিছুই হয়নি। এ দৃশ্য দেখে হযরত জিবরাঈল (আ) স্থম্ভিত হয়ে ইবরাহীম (আ)-এর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।
👉 অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরবর্তী ঘটনা:
হযরত ইবরাহীম (আ) অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরে বাদশাহ নমরূদ তার সমস্ত লোকজনসহ সবিস্ময়ে দেখল যে. অগ্নিকুণ্ডের চতুর্দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। অথচ তার মধ্যস্থলের আগুন নির্বাপিত, সেখানে একটি ফুলের বাগান সৃষ্টি হয়েছে। আর তার কেন্দ্রস্থলে একখান। স্বর্ণ পালংকে হযরত ইবরাহীম (আ) আসীন হয়ে পরম আনন্দে আল্লাহর গুণগান করছেন। এ বিস্ময়কর ঘটনা দেখে বাদশাহ নমরূদ হতবাক হয়ে বলল, হায়, আমার এত শ্রম-চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। এ আশ্চর্য ঘটনা চোখের উপরে দেখে বহুসংখ্যক কাফির তখন তখনই হযরত ইবরাহীম (আ) এর প্রচাবিত সত্যধর্মে দীক্ষিত হল।
কিন্তু এ ঘটনায় পাপীষ্ঠ নমরূদের মন নরম তো হলই ন। ববং সে আবার বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। সে হযরত ইবরাহীম (আ)-কে হত্যা করার জন্য ভিন্ন পন্থায় পুনরায় উদ্যোগী হল। সে তার লোক-লশকরকে বলল যে, ইবরাহীমকে আগুনে ন। জ্বালালেও আমরা ইবরাহীমকে অন্যভাবে হত্যা করব। তোমরা সবাই তাকে লক্ষ্য করে চতুর্দিক থেকে বড় বড় প্রস্তর খণ্ড নিক্ষেপ করতে থাক। দেখি এখন ইবরাহীম কিসের জোরে নিজেকে বাঁচায়। নমরূদের নির্দেশে তার লোক-লশকর হযরত ইব্রাহীমের উপর বৃষ্টির মত প্রস্তরখণ্ড বর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু আল্লাহর অসীম কুদরতে একটি পাথর খণ্ডও তাঁর নিকট পৌছুল না। প্রস্তর খণ্ডগুলো সবই বাতাসের সাথে শূন্যে ভাসতে লাগল।
নমরূদ এবার তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হল দেখে হযরত ইবরাহীম (আ)-কে লক্ষ্য করে বলল, হে ইবরাহীম। এতক্ষণে আমার মনে হচ্ছে যে, তোমার আল্লাহ সত্যই অদ্বিতীয় ও তিনি অসীম ক্ষমতাধর। তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। এবার আমি তোমার আল্লাহর উপরে ঈমান আনতে প্রস্তুত, তবে আমার একটি শর্ত আছে। তা তোমার নিকট বলব। তার পূর্বে তুমি ওখান থেকে বেরিয়ে আমার নিকটে আস। হযরত ইবরাহীম (আ) বের হয়ে নমরূদের নিকট এলে বলেন, বল তুমি আল্লাহর উপর ঈমান আনতে কি শর্ত প্রয়োগ করতে চাও?
নমরূদ বলল, আমি তোমার সামনেই আল্লাহর নামে একলক্ষ চারি হাজার উট, দুম্বা, বকরী এবং গাভী কোরবানী করব। তারপর আমি আমার খাজাঞ্চিখানাগুলো হতে বিশটি খাজাঞ্চিখানার সমস্ত স্বর্ণ ও রৌপ্য আল্লাহকে উপহার দেব। তাঁর নিকট আমার দাবী শুধু আমি তাঁর ধর্মে দীক্ষাগ্রহণ এবং আমার এ সমস্ত উপঢৌকন প্রদান করলে তিনি তোমাকে যে রূপ কেরামতি দিয়েছেন আমাকে তদ্রূপ কেরামতি দান করবেন। যার বদৌলতে তুমি আমাদের সকলকে বিস্ময়াবিষ্ট করে দিয়েছ।
নমরূদের কথা শুনে হযরত ইবরাহীম (আ) বলেন, তুমি আমার মহান আল্লাহর সম্পর্কে কোন ধারণাই করতে পার নি। তিনি কারও নিকট হতে কোনরূপ রেসওয়াত গ্রহণ করেন না।
তিনি যাকে দান করেন, তার নিকট থেকে তার বদলে কোন কিছুই তিনি গ্রহণ করেন না। আর হে অবুঝ বাদশাহ! তুমি যে তাঁকে উপহার বা উপঢৌকন দিতে চাও, তুমি কি জান সে মাল ও দৌলত কার? এসম্পদ কি তোমার? তুমি কোথায় এসব পেয়েছ? এগুলো সবই তো তোমার প্রতি তাঁর করুণা। তুমি যে এ বিশাল ভূ-খণ্ডের অধিপতি হয়েছে তাও কেবল তাঁরই করুণা। তার করুণা না হলে তুমি এর কোন কিছুরই মালিক হতে না-নিজেকে বাদশাহ বলে প্রকাশ করতে পারতে না। এ পর্যন্ত বলে হযরত ইবরাহীম (আ) নিজের গৃহে চলে গেলন। এদিকে বাদশাহ নমরুদ তাঁর কথাগুলো শুনে চিন্তান্বিত হয়ে পড়ল।
সে ভাবতে লাগল, ইব্রাহীমের কথাগুলো তো অত্যন্ত পরিষ্কার, কোন জড়তা বা অস্পষ্টতা নেই তাঁর কোন কথায়। নিশ্চয়ই সে তার অদৃশ্য আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা বলেই এত শক্তিমান। আমি তো তার সাথে কোনদিন কোন কথায়, কোন যুক্তিতে বা শক্তিতে পেরে উঠবনা। তবু কেন তাঁর সে আল্লাহর উপরে বিশ্বাস আনব না।
যেই ভাবা সেই কাজ, অমনি সে উঠে তার প্রধান উজীরের কাছে গিয়ে ব্যস্ততার সাথে বলল, উজীর! চল আমরা ইব্রাহীমের নিকট গিয়ে তাঁর খাঁটি ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করি। নমরূদের প্রধান উজীরের অন্তরে পাপ ও আল্লাহর সাথে অবাধ্যতা এমনভাবে মিশে গিয়েছিল যে সেখানে পূণ্যের সামান্য লেশটুকু ঢুকবার কোন পথ ছিল না। সে বাদশাহর এ ভাবান্তর লক্ষ্য করে তাকে নানাভাবে অমূলক কথা দ্বারা প্রবোধ দিতে শুরু করল যে, জাঁহাপনা। আপনি হয়ত ইব্রাহীমের আগুন হতে বাঁচিয়ে থাকায় খুবই গুরুত্ব প্রদান করছেন, আসলে এ ব্যাপারটি মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইবরাহীম প্রকাশ্যে যদি নিরাকার খোদার কথা মুখে বলত মূলে সে ছিল আগুনের উপাসক। আমি অতি বিশ্বস্তসূত্রে এ তথ্য উদঘাটন করেছি। আগুনের ভক্ত এবং উপাসক বলেই সে অগ্নি দ্বারা দপ্তিভূত হয়নি। সুতরাং আপনি তার ছলনায় ভুলে যদি নিজের ইজ্জত-সম্মান বিসর্জন দিয়ে একটা কিছু করে বসেন, তা হবে আপনার ভবিষ্যতের অনুশোচনার একমাত্র কারণ। তাছাড়া সমগ্র রাজ্যের প্রজারা যেখানে আপনাকে প্রভু হিসাব পূজা করে, সেখানে আপনি নিজে যদি কল্পিত কাউকে নিজের রব বলে স্বীকার করেন তবে আপনি দেশের প্রজা সাধারণের নিকট মুখ রাখবেন কি করে? আর এতকালের ভূমিকা সম্পর্কেইবা তাদের কি বলবেন, কাজেই একটু ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া কি ঠিক নয়।
উজীরের বক্তব্যে নমরূদের পরিবর্তিত মনের অবস্থা আবার পূর্বের মত হল। তার আর আল্লাহর আনুগত্য করা হল না, নমরূদ সে নমরূদই থেকে গেল।
✅রেফারেন্স: কাসাসুল আম্বিয়া
(৪র্থ পর্ব আসিতেছে ইনশাআল্লাহ)