সোনালী লাইফের পরিনতির আশঙ্কা মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের পরিবারের দখলে রূপালী ইন্সুরেন্স

এই বাংলা প্রতিবেদনঃ দেশের বীমা খাতে সংঘটিত দূর্নীতি, আত্মসাত ও লুটপাটের বৃহত্তর ঘটনাগুলোর মধ্যে সোনালী লাইফের ঘটনাটি অন্যতম। মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের পরিবার সংঘবদ্ধভাবে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ১৮৭ কোটি টাকা আত্মসাত করে।
কয়েক মাস আগে এ ঘটনা ছিল দেশের বীমা বাজারে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। গোলাম কুদ্দুস পরিবারে আত্মসাত, লুটপাটের এ ঘটনা আস্থা-অস্তিত্ব সংকটে থাকা বীমা খাতকে আরো আস্থাহীন করে তোলে। দূর্নীতি, আত্মসাতের এই বরপুত্র মৃত্যু মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের পরিবারের নিয়ন্ত্রনে চলছে শেয়ার বাজারে তালিকাভূক্ত নন লাইফ বীমা কোম্পানি রূপালী ইম্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। এই কোম্পানিটিও সোনালী লাইফের পরিণতির দিকে এগুচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন বীমা খাতের সংশ্লিষ্ট অনেকে।
কোম্পানিটির ওয়েবসাইট, ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের ছেলে মোস্তফা কামরুস সোবহান, মেয়ে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে রয়েছেন ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া, পরিচালক পদে রয়েছেন আরেক মেয়ে তাসনিয়া কামরুন অনিকা ও স্ত্রী ফজিলাতুননেসা।
এছাড়া কোম্পানিটির ওয়েব সাইটে প্রদর্শিত পরিচালকদের সিংহভাগই কুদ্দুস পরিবারের ঘনিষ্ঠ অথবা কুদ্দুস পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এ কোম্পানীর চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্য কয়েকজন পরিচালকই বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্ট অনুযায়ী ঋণ খেলাপী। এরা কিভাবে পরিচালক পদে বহাল রয়েছে এ নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
বীমা আইন অনুযায়ী একই পরিবারের কয়জন সদস্য একটি বীমা কোম্পানির পরিচালক পদে থাকতে পারেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিআরএ এর একজন উর্ধ্বতম কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বীমা আইন অনুযায়ী একটি কোম্পানিতে একই পরিবারের দুইজন পরিচালক থাকতে পারেন।
বীমা আইনকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে এই লুটেরা পরিবারটির চারজন সদস্য মিলে রুপালী ইন্সুরেন্স কোম্পানিটি নিজেদের দখলে রেখেছে। এ বিষয়ে আইডিআরএ এর ভূমিকাও রহস্য জনক বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদেন অনুসন্ধান করে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানটির স্পন্সর শেয়ার হোল্ডার ও পরিচালকদের কোন তথ্য প্রদান করা হয় নি।
কি কারনে স্পন্সর শেয়ার হোল্ডার ও পরিচালকদের কোন তথ্য প্রকাশ করা হয় নি এ বিষয়ে জানতে, কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানিটির বর্তমান এডভাইজার পি.কে রায়কে তার হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।
প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদনে ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গ্রোস প্রিমিয়াম আয় দেখানো হয়েছে ৩৩১কোটি ৭০লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এর বিপরীতে রিইন্সুরেন্স প্রিমিয়াম বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ১৩৪ কোটি ৮০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। এ সময় ক্লেইম বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৫৫ কোটি ৮০ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।
এদিকে ২০২৪ সালের বীমা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত রি ইন্সুরেন্স প্রতিবেদন সুত্রে জানা যায়, রূপালী ইন্সুরেন্স কোম্পানির রি ইন্সুরেন্স বাবদ বকেয়া রয়েছে ২৩ কোটি ৯ লাখ ৮৩ হাজার ৬৭১ টাকা।
এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ব্যলেন্সশীটে মিডল্যান্ড ব্যাংক থেকে ৯ কোটি টাকা এফডিআর এর বিপরীতে ৮ কোটি ঋণ গ্রহন করেছে বলে দেখানো হয়েছে। কেন এই লোন গ্রহন করা হয়েছে এবং কোন খাতে এ টাকা ব্যয় করা হয়েছে এর সুনির্দিষ্ট কোন ব্যাখ্যা করা হয় নি ওই বেলেন্সশীটে।ব্যলেন্সশীটে ম্যানেজমেন্ট এক্সপেন্স বিশাল অংকের টাকা প্রদর্শন করা হলেও ব্রেক আপে তা সুস্পষ্ট করে দেখানো হয় নি।
বীমা মার্কেট অনুসন্ধানে জানা যায়, অন্যান্য বীমা কোম্পানীর সাথে পাল্লা দিয়ে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন প্রদান করে পলিসি সংগ্রহ করছে রুপালী ইন্সুরেন্স। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, কোম্পানীটি বছরে শত কোটি টাকার বেশী ব্যবসা করছে।
তবে অতিরিক্ত কমিশন সমন্বয় করার জন্য ব্যবসার বড় একটা অংশ গোপন করে রাখছে। সমন্বয়ের এ কাজটি দক্ষতার সাথে করে দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটি সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বর্তমান এডভাইজার পি.কে রায়। তার এ য়োগ্যতার জন্য চাকুরী শেষেও চাকুরীর সকল সুযোগ সুবিধা দিয়ে তাকে কোম্পানীর এভাইজার পদে রাখা হয়েছে।
এদিকে গত পাচ বছরে কোম্পানীটির ক্লেইম বাবদ দেখানো ৫৫ কোটি ৮০ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। বিশাল অংকের এ ক্লেইমের সিংহভাগই অস্তিত্বহীন বলেও সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা যায়।
অপর একটি সূত্র জানায়, ৩৬ বছরে কোম্পানীটির মোট সম্পদের পরিমান ২৬৪কোটি ৩০ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। শেয়ার হোল্ডারদের ইক্যুইটি ১৮৭কোটি ৬০ লাখ টাকা ৪১ হাজার টাকা বাদ দিলে কোম্পানীটির ৩৬ বছরে আয় হয় ৭৬ কোটি ৭০লাখ ২৭ হাজার টাকা। সম্পদের পরিমান টাকা ইক্যুইটির টাকা বাদ দিলে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি খুবই নগন্য। বছরে রুপালী ইন্সুরেন্স কোম্পানি গড়ে নিট লাভ করে ২কোটি ১৩ লাখ ৬ হাজার ৩০৫ টাকা। তবে লোন ও বকেয়া রি ইন্সুরেন্স প্রিমিয়ামের টাকা বাদ দিলে এ অংক আরো কমবে।এই কোম্পানিটিতেও মা, ছেলে, দুই মেয়ে ও মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের ঘনিষ্ঠজনরা মিলে সোনালী লাইফের মত লুটপাট জড়িত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট অনেকে আশঙ্কা করছেন।
আইডিআরএ পক্ষ থেকে বীমা খাতে আরেক অঘটন ঘটার আগে স্বাধীন নিরীক্ষক নিয়োগ করা হলে সকল কুদ্দুস পরিবারের অনিয়ম, দূর্নীতি বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট অনেকে।
বীমা খাত নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হলো। ভিন্ন ভিন্নভাবে বীমা শিল্পের অনিয়ম, দূর্ণীতি-লুটপাট তুলে ধরা হবে পরবর্তী পর্ব সমূহে।