ভুয়া প্রযোজকের নাইকা বানানোর ফাঁদ, প্রেম,বিয়ে, অতঃপর ধ র্ষণ, অন্ধ দেশের আইন

নূর হোসেন ইমাম, অনলাইন এডমিনঃ পৃথিবীতে ভালোবাসার রঙ এক একজনের কাছে একেক রকম। সেই রঙিন স্বপ্নের দুনিয়ায় নিজেকে গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলেন নারী উদ্যোক্তা সোনিয়া আক্তার কেয়া। নিজের ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি নিজেকে দেখতে চেয়েছিলেন টেলিভিশনের পর্দায়—হতে চেয়েছিলেন একজন চিত্রনায়িকা।
আর সেই স্বপ্ন পূরণের পথেই এক সময় পরিচয় হয় মিডিয়ার একজন পরিচালকের বন্ধু মাহমুদুল হাসান সোহাগের সঙ্গে। শুরুতে ছিলো সাদামাটা আলাপচারিতা, তারপর গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব এবং সেই বন্ধুত্ব রূপ নেয় প্রেমে। প্রেম পরিণয় পায় বিয়েতে। কিন্তু কেয়া জানতেন না, এই প্রেম ও বিয়ে একদিন তাকে বাংলাদেশের আইন-আদালত এবং প্রশাসনের নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করাবে।
তবে প্রশ্ন থাকে—কে আসলে অপরাধী? কেয়া, নাকি তার নতুন স্বপ্ন?
আজকের প্রতিবেদনে আমরা জানবো কেয়ার জীবনের সেই বাস্তব গল্প এবং তার পেছনের রহস্য।
পরিচয় ও প্রেমের শুরু
কেয়া একসময় প্রডিউসার আজিজ কায়সারের সেটে কাজ করতেন। সেই সূত্রে শিল্পকলা একাডেমিতে একদিন আজিজ কায়সার তাকে পরিচয় করিয়ে দেন মিডিয়া পরিচালক আব্দুল্লাহ আকাশের সঙ্গে। কিছুদিন পর, আকাশ পরিচয় করিয়ে দেন আরেক প্রডিউসার মাহমুদুল হাসান সোহাগের সঙ্গে।
পিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে—পরিচয়ের পর আকাশ কেয়াকে জানান, সোহাগ একজন প্রডিউসার যিনি সামনে একটি ছবিতে তাকে নিয়ে কাজ করতে চান। সেখান থেকেই শুরু হয় ঘনিষ্ঠতা। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, আর প্রেম গড়ায় বিবাহে।
বিয়ের পরদিনগুলো ও প্রতারণার সূচনা
কেয়ার দাবি অনুযায়ী, দুজনেই ছিলেন এক সন্তানসহ একক অভিভাবক (Single parent)। তারা একসাথে সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখেন। সেই উদ্দেশ্যে ২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট, ঢাকা জজ কোর্টে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে কোর্ট ম্যারেজ করেন তারা। সেখানে আইনজীবী হিসেবে সাক্ষর ও সিল ছিল অ্যাডভোকেট জাহিদুর ইসলামের।
বিয়ের পর তারা একসাথে সময় কাটান, কেয়া’র বাসায় থেকে থাকেন, এমনকি রিসোর্টেও ঘুরতে যান। এসবের প্রমাণস্বরূপ নানা ধরনের ডকুমেন্ট কেয়া সংরক্ষণ করেছেন যা আমাদের দিয়েছেন কেয়া । তবে সময়ের সাথে সাথে শুরু হয় সন্দেহ। কেয়া যখন সোহাগের বাড়ি যেতে চেয়েছেন, তখন সোহাগ জানায়, তার বাড়িতে ১০ তলা ভবনের কাজ চলছে—শেষ হলে নিয়ে যাবেন।
কিন্তু ডিসেম্বর মাসে কেয়া জানতে পারেন, সোহাগ আসলে বিবাহিত এবং তার সন্তান ও স্ত্রী দুজনেই রয়েছে নিজ বাড়িতে।
প্রতারিত কেয়ার আইনি আশ্রয় ও প্রতিরোধ
এই সত্য জানার পর ২০২৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কেয়া যোগাযোগ করেন সোহাগের বন্ধু আজিজ কায়সারের সঙ্গে। অভিযোগ রয়েছে, আজিজ কায়সার ও সোহাগ মিলে রামপুরা লিংক রোডে কেয়ার ওপর হামলা চালান। এই ঘটনায় কেয়া ২০ মার্চ রামপুরা থানায় একটি জিডি করেন (নং: ১১/৫২), এবং চিকিৎসা নেন কুর্মিটোলা হাসপাতালে।
আইনের আশ্রয় নিতে গিয়ে কেয়া পড়েন নতুন বিপদে। একজন আইনজীবী তার বিয়ের কাগজপত্র দেখে বলেন, কাগজগুলো জাল। তাকে ধর্ষণ মামলার পরামর্শ দেন। ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল, কেয়া ঢাকা নারী ও শিশু আদালত-৮-এ মামলা করেন (নং: ২৪/৪২)।
হুমকি, নির্যাতন ও প্রাণনাশের আশঙ্কা
এরপর থেকে শুরু হয় হুমকি, ভয় দেখানো এবং দফায় দফায় ফোন কল। জুয়েল নামের এক ব্যক্তি নিয়মিত কেয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাকে জীবননাশের হুমকি দেন। এসব কল রেকর্ড কেয়ার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
এরপর কেয়ার সঙ্গে পুনরায় ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর নাটক সাজিয়ে তাকে কক্সবাজার ঘুরতে ও নতুনভাবে সংসার শুরু করার প্রলোভন দেখিয়ে বগুড়ায় ডেকে নেয় সোহাগ। কেয়া জানান, সেখানে তাকে একটি অর্ধ-নির্মিত ভবনে নিয়ে গিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার করা হয়। এরপর তাকে বাসে তুলে ঢাকায় ফেরত পাঠানো হয়, হুমকি দিয়ে বলা হয়—বগুড়ায় আর গেলে লাশ হয়ে ফিরতে হবে।
বগুড়া থানায় হয়রানি ও পুলিশ কর্মকর্তার অমানবিক আচরণ
বগুড়ায় ফিরে কেয়া ২৮ নভেম্বর থানায় একটি জিডি করেন। কিন্তু প্রাথমিকভাবে পুলিশ জিডি গ্রহণ করতে চায়নি। পরবর্তীতে পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপে জিডি গ্রহণ করতে বাধ্য হয় তারা। মামলা করার জন্য সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বসিয়ে রাখা হয় কেয়াকে।
এ সময় বগুড়া সদর সার্কেল এসপি সরাফত ইসলাম কেয়ার কাছে জানতে চান কেন মামলা করতে চান। কেয়া তার সমস্ত অভিজ্ঞতা খুলে বললে এসপি হাসতে হাসতে বলেন, “তারা বিএনপির নেতা, আপনি মামলা করে কিছু করতে পারবেন না।”
তদন্তে গড়িমসি ও দুর্নীতির অভিযোগ
কেয়ার ধর্ষণ মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় পিবিআই ইনস্পেক্টর বাকি বেগকে। কিন্তু তিনি কোনও মেডিকেল পরীক্ষা ছাড়াই মনগড়া তদন্ত রিপোর্ট জমা দেন। কেয়ার অভিযোগ—বাকি বেগ তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ আলামত না নিয়েই ভুল রিপোর্ট জমা দেন।
বাকি বেগ জানান, কেয়া তার পোশাক দেননি। কিন্তু কেয়া এটিকে মিথ্যা দাবি করে বলেন, বাকি বেগ ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল রিপোর্ট দিয়েছেন। বাকি বেগ পরবর্তীতে জানান তিনি দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগছেন এবং এ বিষয়ে কিছু বলতে চান না।
কেয়ার নারাজি দেওয়ার পর আদালত তদন্ত রিপোর্ট বাতিল করে সিআইডির খালেদা ইয়াসমিনকে নতুন তদন্তভার দেন। তদন্ত চলাকালীন খালেদা জানান, সোহাগের এক বন্ধু তাকে খামে করে ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করেন—যেখানে ছিল ২০ হাজার টাকা। বিষয়টির অডিও রেকর্ড ও টেলিভিশন সাক্ষাৎকার কেয়া সংগ্রহ করেছেন।
শেষ কথা
এই দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষ কোথায়, তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে এক নারী উদ্যোক্তা কীভাবে প্রেম, প্রতারণা এবং দুর্বল আইনব্যবস্থার বলি হয়েছেন, সেই নির্মম বাস্তবতা কেয়ার জীবনে প্রতিচ্ছবি হয়ে রয়ে গেছে।
মাহমুদুল হাসান সোহাগকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
ভিডিও প্রতিবেদন এ থাকছে বিস্তারিত……।