রাজনীতি

সাড়ে ১০ বছর পর খুনি ডিসি-এসপিসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা: সাতক্ষীরায় ২০১৪’র দমন-পীড়নের বিচার শুরু

সাতক্ষীরায় ২০১৪ সালের আলোচিত দমন-পীড়ন, বাড়িঘর গুড়িয়ে দেওয়া, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সাড়ে ১০ বছর পর সাবেক ডিসি ও এসপিসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে খুন ও ধ্বংসযজ্ঞের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় প্রথমবারের মতো প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রক্রিয়া শুরু হলো।

আসামির তালিকায় সাবেক ডিসি-এসপি, ১৫ পুলিশ সদস্য ও ১০ আওয়ামী লীগ কর্মী

মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব ও ২০১৪ সালে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসানকে। একইসঙ্গে তৎকালীন পুলিশ সুপার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবীর, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান, সদর থানার ওসি ইনামুল হকসহ পুলিশের আরও ১২ জন এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের ১০ নেতাকর্মীর নাম রয়েছে এজাহারে।

বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ

সাতক্ষীরা সদরের বৈচনা গ্রামের বাসিন্দা ও ভোমরা ইউনিয়ন জামায়াতের আমির মাওলানা মো. ওবায়দুল্লাহ এই মামলা দায়ের করেন। তার অভিযোগ—২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি ‘সরকারি সভার’ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যৌথবাহিনী (পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি) ও আওয়ামী ক্যাডাররা তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে তা গুঁড়িয়ে দেয়। সাথে চলে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক কোটি টাকা বলে জানান তিনি।

আদালতের নির্দেশ: তদন্ত করে মামলা নিন

সাতক্ষীরা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মায়নুদ্দিন মামলাটি আমলে নিয়ে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তদন্তপূর্বক এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

“শেখ হাসিনার নির্দেশে দমন-পীড়ন”: বাদীর অভিযোগ

বাদী ওবায়দুল্লাহ অভিযোগ করেন, “২০১৪ সালে শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে সাতক্ষীরায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দেওয়া হয়। আমার বাড়িতে যৌথবাহিনী ও সরকারি দল মিলে হামলা চালায়। আজও এর ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি।” তিনি আরও বলেন, “শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর এসপি মঞ্জুরুল কবীর দেশত্যাগ করেন। অথচ সেই সময়কার ডিসি নাজমুল আহসান এখনও সচিব হিসেবে বহাল তবিয়তে আছেন।”

সাতক্ষীরায় ২০১৪ সালের সরকারি অভিযানে নিহত ৪৩, গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ২৭ জন

বাদীপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরায় ২০১৩ সালের শেষদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে যৌথবাহিনীর নামে চালানো অভিযানে ৪৩ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে ২৭ জনই পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এদের সবাই বিএনপি-জামায়াত ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ছিলেন বলে দাবি করা হয়।

আইনজীবীর ভাষ্য: ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে মামলা করা যায়নি’

বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, “২০১৪ সালে আতঙ্কের পরিবেশ, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও প্রশাসনের সম্পৃক্ততার কারণে মামলা করা সম্ভব হয়নি। এখন পরিবেশ কিছুটা অনুকূল হওয়ায় আমরা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি।”

পেছনের প্রেক্ষাপট: নজিরবিহীন দমন অভিযান

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বিরোধী দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যৌথবাহিনীর অভিযানে সাতক্ষীরার শতাধিক বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বুলডোজার দিয়ে বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় সাথে ছিল সরকারি দলের ক্যাডাররা, যারা মালপত্র লুটে নেয়। এ সময় একাধিক মানুষ গুম ও গুলি চালনার শিকার হন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উত্থাপন

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর একাংশ মনে করে, সরকারি নির্দেশে সংঘটিত এই দমন-পীড়ন আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় পড়ে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারযোগ্য হতে পারে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button