দুর্নীতি

বরিশাল বিআইডব্লিউ-টিসির নির্বাহী প্রকৌশলী  মোঃ হাসান শেখ দূর্নীতির লাগাম টেনে ধরার সাধ্য আছে কার?

রাশেদুল ইসলাম

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন। সংক্ষিপ্ত রূপ বিআইডাব্লিউ­টিসি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত সেবাধর্মী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এটি। দেশের মূল ভূখন্ড ও দ্বীপাঞ্চলের মধ্যে নিরাপদ যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করা এবং নিরবিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা রক্ষায় দক্ষ সার্ভিস নিশ্চিত করা এ সংস্থার প্রধান মিশন আর অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌ রুটে নিরাপদ যাত্রী, যানবাহন ও পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা তাদের ভিশন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে দেশের সার্বিক যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে ৬১১ টি বাণিজ্যিক ও সহায়ক জাহাজ নিয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ- পরিবহন করপোরেশন প্রতিষ্ঠা লাভ। তবে দিনদিন তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সফলতার পাল্লা ভারি হওয়ার বদৌলতে প্রতিষ্ঠানটি ধাবিত হচ্ছে লোকসানের দিকে। বর্তমানে এ সংস্থা ১৩১টি বাণিজ্যিক জাহাজ এবং ৫৩টি সহায়ক জাহাজসহ সর্বমোট ১৮৪টি জাহাজের মাধ্যমে হরিলুটের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সংস্থাটির কার্যক্রমের মধ্যে সবার উপরে রয়েছে ফেরি সার্ভিস। পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া, পাটুরিয়া থেকে কাজীরহাট, শিমুলিয়া- বাংলাবাজার, শিমুলিয়া-মাঝিকান্দি, চাঁদপুর-শরীয়তপুর, ভোলা-লক্ষ্মীপুর, ভেদুরিয়া-লাহারহাট রুটে চলে তাদের ফেরি সার্ভিস। এছাড়া যাত্রীবাহী সার্ভিস কন্টিনার, ও কার্গো সার্ভিস, শিপ রেফিয়ার সার্ভিস, ওয়াটার বাস সার্ভিস, রেকার সার্ভিস কার্যক্রম ও পরিচালনা করছে সংস্থাটি। বর্তমানে সংস্থাটির দূনীতি ও অনিয়ম সব কিছুতে ছাপিয়ে গিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে গেছেন। তাদের দূনীতি ও অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধান করছে অপরাধ বিচিত্রা। শুরুতে অনুসন্ধানী দলের চোখ ভেদুরিয়া-লাহারহাট রুটে ফেরি সার্ভিসের দিকে। ভেদুরিয়া-লাহারহাট রুটে মোট ফেরির সংখ্যা ৬টি তবে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি যানবাহনের সংখ্যা বাড়লেও অনিয়ম ও দূর্নীতির চাপে কমেছে ফেরির সংখ্যা। বর্তমানে এই রুটে ফেরি অপরাজিতা, শাপলা শালুক, মাদবী লতা, চন্দ্র মল্লিকা, দোঁলনচাপা ও কৃষ্ণচূড়া নামে মোট ছয়টি ফেরি চলাচল করছে। আবার এসব ফেরিতে অদক্ষ কর্মচারীর সংখ্যাই বেশি। নিয়োগের ক্ষেত্রেও করা হয়েছে নানা অনিয়ম, যেমন: ঐ রুটের ম্যানেজারের দায়িত্ব পেতে হলে গুনতে হয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা, এই টাকা বিআইডবিøউ-টিসির ঢাকা কর্পোরেট অফিসের সিনিয়র কর্তাদের পকেটে চলে যায়। বেশ কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার ইশারায় বদলী বাণিজ্য পদ-পদবী এবং তৈল চুরির মতো ন্যক্কারজনক কর্মকান্ড চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এদের দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার সাধ্য আছে কার? ভেদুরিয়া-লাহারহাট নৌ রুটে অদক্ষ অযোগ্য একঝাঁক দুর্নীতিবাজ কর্মচারী কর্মকর্তা দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে তাদের কার্যক্রম, যে কারণে ফেরি চলাচলের সময় নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় সেবা গ্রহীতাদের। অনুসন্ধান বলছে, চট্টগ্রাম থেকে প্রথমে তেল পাঠানে। হয় বরিশালের মেঘনা ডিপোতে। সেখান থেকে ভেদুরিয়া-লাহারহাট রুটের ফেরি অপারাজিতা, দোঁলনচাপা, শাপলা শালুক, মাদবী লতা, চন্দ্র মল্লিকা, কৃষ্ণচুড়া ফেরির নামে মাসে দুটো ভাউসারে প্রায় চল্লিশ হাজার লিটারের উপরে ফুয়েল বরাদ্দ নেয়া হয়। এর মধ্যে অপরাজিতা ও দোঁলনচাপা ফেরির নামে কোন কোন মাসে দুই ধাপে ১৫ হাজার লিটার করে মোট ৩০ হাজার লিটার বরাদ্দ নেয়ার তথ্য আছে। তবে ভাউচার অনুযায়ী বরাদ্দের সব তেল ফেরিতে দেয়া হয়না। বরাদ্দের অর্ধেক তেল অবৈধভাবে ৯৫ টাকা দরে হিসেব করে বিক্রি করে দেয়া হয় বরিশালের ওই মেঘনা ডিপোতে। এভাবে প্রতিমাসে দুইবার করে প্রায় ৪০-৫০ হাজার লিটার তেল হরিলুট করে, অপরাজিতা, শাপলা শালুক, মাদবী লতা, দোলন চাপা ও কৃষ্ণচূড়া নামে মোট ছয়টি ফেরি থেকে। বিআইডবিøউটিসি বরিশাল অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান শেখ, ফেরিঘাটের বাণিজ্য বিভাগের ব্যবস্থাপক শিহাব উদ্দিন, মেরিন অফিসার আলিমুজ্জামান ও হিসাব রক্ষক কামাল হোসেন। তেল বুঝে পাওয়ার রশিদে ফেরির মাস্টার ও ড্রাইভার ইনচার্জের স্বাক্ষর নিতে হয়। আর তাই তেল চুরির মাধ্যমে যে টাকা আত্মসাৎ করা হয় তার ৪০ ভাগ চলে যায় অপরাজিতার মাস্টার, দোলন চাপার মাস্টার, মাদবী লতার মাস্টার, কৃষ্ণচূড়ার মাস্টারসহ ফেরীর কর্মচারীদের কাছে। আর তেল চুরির বাকী ৬০ ভাগ পান চক্রের অন্য সদস্যরা। এ চক্রের সদস্য হিসেবে মেঘনা ডিপোর ম্যানেজারও মোট টাকার ৬ শতাংশ ভাগ পান। আর মাস শেষে মাসোহারা হিসেবে ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে পৌঁছে যায় মোটা অংকের টাকা। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনার অজুহাতে প্রতিমাসে প্রায় ১০ বার ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। ভাউচারে ভালোমানের মালামালের দাম বসানো হলেও মূলত নিম্নমানের পণ্য আনা হয়, আবার যন্ত্রাংশ ক্রয় না করে ভাউচার দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করে চলে যায় তার পকেটে। বরিশাল অফিসে বসে কৌশলে এ টাকা হাতিয়ে নেন নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান শেখ। মাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকার উপরে তার পকেটে  চলে যায়। এছাড়াও কাঠ ও বিভিন্ন কাঁচামাল এবং সবজির গাড়ি থেকে নেয়া হয় বাড়তি টাকা। সরকার নির্ধারিত ২ হাজার ৪শ টাকার গাড়ি থেকে নেয়া হয় ৪ হাজার টাকা, ২ হাজার ২শ টাকার গাড়ি থেকে নেয়া হয় ৩ হাজার টাকা। আর এসব অবৈধ টাকা আত্মসাৎ করে বরিশাল অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান, ফেরিঘাটের বাণিজ্য বিভাগের ব্যবস্থাপক সিহাব উদ্দিন। যেকারণে ফেরি পার হয়ে ভোক্তা পর্যায়ে যাওয়ার পর জিনিসের দাম অনেক বেশি বেড়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘাটের একজন কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা ও মেরামতের নামে মোটা অংকের টাকা আত্মসাত করেন নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান শেখ। বিভিন্ন ভুয়া ভাউচারে তিনি সরকারি টাকা আত্মসাত করলেও ফেরির উন্নয়নে কোন কাজ তিনি করেন না। আর ম্যানেজার সিহাব উদ্দিন বড় গাড়ি, ছোট গাড়ি হিসেব করে টাকা নেন ইচ্ছে মতো। এছাড়া তেল থেকে বরাদ্দের সব তেল চুরিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অবৈধভাবে মাসে প্রায় ১০ লাখ টাকা আয় হচ্ছে ম্যানেজার সিহাব উদ্দিনের। দোলন চাপা ফেরিতে চলাচলের সময় মিজান নামে একজন ট্রাক চালক বলেন, ট্রাকে করে মাল নিয়ে যাচ্ছেন ফেনীতে। ফেরিতে চলাচলের জন্য সরকারি ফি দুই হাজার একশো চল্লিশ টাকা হলেও জোর করে নেয়া হয়েছে দুই হাজার চারশো টাকা। বাড়তি যে টাকা নেয়া হয়েছে সেটার অর্ধেক দিবে মালিক আর বাকী অর্ধেক নিজের পকেট থেকে দিতে হয়। মেসার্স যমুনা ট্রান্সপোর্ট নামে একটি বড় লরি চালক মিলন নামে একজন বলেন, সরকারি ফি আট হাজার টাকা হওয়ার পরও ঘাট পার হওয়ার সময় নিয়েছে ছাব্বিশ হাজার টাকা। আর ফিরে আসার সময় নিয়েছে ১৮ হাজার ৮শ টাকা। এরপর আবার তিনশো টাকা চাঁদাও দিতে হয়েছে। টাকা নেয়ার পর ঘাট থেকে কোন ধরনের টোকেনও দেয়া হয়নি। অভিযোগের বিষয়ে ম্যানেজার সিহাব – উদ্দিন বলেন, আমি তো ফেরিঘাটে গিয়ে বসে থাকি না। ঘাটে আমার নাম্বার দেয়া আছে। ড্রাইভাররা আমার কাছে অভিযোগ করেনি। লাহারহাট-ভেদুরিয়া ঘাটের দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে ম্যানেজার সিহাব উদ্দিন অনুসন্ধানী দলের প্রধান রাশেদুল ইসলামকে মোবাইল ফোনে বলেন বরিশাল শহরে আসেন, আবার বলেন বরিশাল প্রেসক্লাবে এসে আমার সাথে দেখা করেন, তিনি আরও বলেন আসেন ভাই এক সাথে চা খাবো।

বিআইডব্লিউটিসি চেয়ারম্যান মহোদয়কে জানানোর দরকার নেই, আমার অবসরে যাওয়ার সময় হয়েছে, আমার ক্ষতি করিয়েন না। দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলতে চাইলে এভাবেই এড়িয়ে যান। এদিকে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান সঞ্জয় কুমার বনিক  (অতিরিক্ত সচিব) কাছে অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অপরাধ বিচিত্রার বার্তা সম্পাদক রাশেদুল ইসলামকে বলেন, অনিয়মের সাথে যুক্ত রয়েছে এমন অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের তথ্য দিন এদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button