অপরাধঅব্যাবস্থাপনা

চাঁদা দাবির পাশাপাশি ইন্টারনেট, পানি ও ময়লার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল সন্ত্রাসীরা

রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৭০০ দোকানের ইন্টারনেট সংযোগ, খাবার পানি সরবরাহ ও ময়লা সরানোর কাজের নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল সন্ত্রাসীরা। পাশাপাশি তারা চাঁদা হিসেবে নগদ অর্থ দাবি করেছিল। দুই দফায় গিয়ে তা না পেয়ে তারা বিপণিবিতানটির দুই ব্যবসায়ীর ওপর হামলা করে।

১০ জানুয়ারি রাতে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে বিপণিবিতানটির ব্যবসায়ী এহতেশামুল হককে কুপিয়ে জখম করা হয়। একই সময় অপর ব্যবসায়ী ওয়াহিদুল হাসানের গাড়িতে হামলা হয়। এ ঘটনায় রাজধানীর নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এ তথ্য জানিয়েছেন।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, এহতেশামুলকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার সময় সন্ত্রাসী দলের ১৫ থেকে ২০ জনের মতো উপস্থিত ছিল। আশপাশের বিভিন্ন স্থানে আরও ২০ জনের মতো অবস্থান নিয়েছিল। এই সন্ত্রাসীরা এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেটসহ আশপাশের এলাকা, ধানমন্ডির কিছু অংশের বিপণিবিতান, ইন্টারনেট, কেব্‌ল টিভির সংযোগ (ডিশ) ও ফুটপাতের চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

নিউমার্কেট থানায় মামলাটি করেছেন মাল্টিপ্ল্যান দোকান মালিক সমিতির নেতা ওয়াহিদুল হাসান। তিনি এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার সমিতিরও সভাপতি। মামলায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।

পুলিশ বলছে, এই মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন আসিফুল হক ওরফে আসিফ ওরফে ঝন্টু (৩২), মো. কাউসার মৃধা (২৪) ও এনামুল ওরফে মুরগি এনামুল। তাঁদের মধ্যে প্রথম দুজন এজাহারভুক্ত আসামি। আর এনামুল সন্ত্রাসীদের তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করেন।

তবে মামলার প্রথম আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনসহ (৫২) অন্য গুরুত্বপূর্ণ আসামিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্য গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের মধ্যে আছেন মুন্না, এ কে এম চঞ্চল ও জসিম ওরফে কালা জসিম।

রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বিপণিবিতান মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে ব্যবসায়ী এহতেশামুল হককে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়

রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বিপণিবিতান মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে ব্যবসায়ী এহতেশামুল হককে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত

এলিফ্যান্ট রোডের ২৪টি মার্কেটের কম্পিউটার ও এ-সংক্রান্ত ব্যবসায়ীদের নেতা ওয়াহিদুল হাসান বলেন, ‘অক্টোবরের দিকে প্রথমে চঞ্চল একদিন সাত থেকে আটজনকে নিয়ে আমার অফিসে আসেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন কথা বলবেন বলে তাঁর ফোন আমাকে ধরিয়ে দেন। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, “আমাদের ছেলেদের পাঠিয়েছি। ওরা যা বলে শুইনেন, ওদেরকে দেখে রাইখেন।”’

মূলত এই ঘটনার পরই সন্ত্রাসীরা মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের দোকানগুলোর ময়লার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয় বলে জানান ব্যবসায়ী নেতা ওয়াহিদুল। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন পর আরেক দিন কালা জসিম আসেন। তিনি ইমনের সেকেন্ড ইন কমান্ড মুন্নাকে ফোনে ধরিয়ে দেন। তখন ইন্টারনেট সংযোগ, খাবার পানি সরবরাহ ও নগদ অর্থ দাবি করা হয়। এগুলো না দিলে সমস্যা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়। এরপর হামলার ঘটনা ঘটে।’

পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ১০ জানুয়ারি রাতে হামলার সময় চঞ্চল ও জসিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। মুন্নাকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি। তবে তিনি হামলা-সংক্রান্ত একটি হোয়াটসঅ্যাপ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এই ঘটনার নেপথ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের সম্পৃক্ততার রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

ব্যবসায়ী এহতেশামুল হকের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি মানববন্ধন করেন বৃহত্তর এলিফ্যান্ট রোডের ব্যবসায়ীরা। ঢাকা, ১১ জানুয়ারি

ব্যবসায়ী এহতেশামুল হকের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি মানববন্ধন করেন বৃহত্তর এলিফ্যান্ট রোডের ব্যবসায়ীরা। ঢাকা, ১১ জানুয়ারিছবি: সংগৃহীত

এলিফ্যান্ট রোড এলাকার পাঁচ ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত ৫ আগস্টের পর থেকে চঞ্চল ও মুন্না এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট এলাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। চঞ্চল নিউমার্কেট থানা যুবদলের নেতা।

১৪ জানুয়ারি চঞ্চলকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় যুবদলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। বলা হয়, বহিষ্কৃত নেতার কোনো অপকর্মের দায়দায়িত্ব সংগঠন নেবে না।

স্থানীয় ব্যবসায়ী ও তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এলিফ্যান্ট রোড ও নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাতের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ ঘিরে কয়েকটি সন্ত্রাসী দল-উপদল এখন তৎপর। এই দল-উপদলগুলোর চাঁদাবাজির টাকার ভাগ শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ বিভিন্ন পর্যায়ে যায়। তারা কেবল ফুটপাত নয়, স্থানীয় বিপণিবিতানগুলোতেও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। হামলার জন্য সন্ত্রাসীরা ভাড়ায় খেটেছেন কি না, তা অনুসন্ধান করছে পুলিশ।

এসব বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের নিউমার্কেট অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) তারিক লতিফ বলেন, ‘ব্যবসায়ীকে কোপানোর ঘটনায় অনেকগুলো বিষয় সম্পৃক্ত থাকতে পারে বলে আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি। যে তিন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সম্পৃক্ততার যে বিষয়টি এসেছে, তদন্তে সেটিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’

নিউমার্কেট থানা-পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ৫ আগস্টের পর শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন কারাগার থেকে জামিনের বের হন। এর আগে তাঁর নামে চাঁদাবাজি হয়েছে। তিনি জামিনে বের হওয়ার পর অসংখ্য অভিযোগ আসছে। ব্যবসায়ীকে কোপানোর ঘটনায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে ইমনের কোন পর্যায়ে যোগাযোগ ছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদিও ইমনসহ মামলার আসামিরা এখন গা ঢাকা দিয়েছেন। তাঁদের মুঠোফোন নম্বরও বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া হাজারীবাগ এলাকায় আলোচনা রয়েছে, ইমন ইতিমধ্যে দেশ ছেড়েছেন। তবে পুলিশের কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই।

মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন সময়ে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে দলবদ্ধ হয়ে এসে বিপণিবিতানের ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা দাবি করতে থাকেন। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ব্যবসায়ীদের ভয়ভীতি-হুমকি দিতে থাকেন। ভুক্তভোগী এহতেশামুল ও ওয়াহিদুল বিপণিবিতানের অন্য ব্যবসায়ীদের নিয়ে এই চাঁদাবাজি-হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে আসামিদের রোষানলে পড়েন। এই প্রেক্ষাপটে আসামিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে হত্যার উদ্দেশে হামলা করেন।

ব্যবসায়ী ওয়াহিদুল হাসান বলেন, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পেত না। আমি যখন সাহস করে কথা বললাম, মামলা করলাম, তখন অনেক ভুক্তভোগী আমার কাছে সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের কথা বলেছেন। মূল সন্ত্রাসীরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় আমি এখন নিরাপত্তাহীনতায় আছি।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button