চিকিৎসাব্যয় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে চিকিৎসাব্যয়। চিকিৎসকদের উচ্চ হারে ফি নেয়া, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধের দাম বৃদ্ধি, দালালদের খপ্পরে পড়ে অযথাই বাড়ছে ব্যয়, রেফারেল পদ্ধতি না থাকায় বিভাগীয় শহর কিংবা রাজধানীতে রোগী আসার কারণেও বাড়ছে চিকিৎসাব্যয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ রোগীকেই চিকিৎসা খাতে অর্থের ভার বহন করতে হচ্ছে। ফলে সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেলে অতি দরিদ্র মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন চিকিৎসাসেবা থেকে। গবেষণা বলছে, চিকিৎসাব্যয় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্যানুসারে চিকিৎসা খাতে দেশে প্রতি বছর মাথাপিছু খরচ হয় গড়ে ৩০ মার্কিন ডলার। এই খরচের মাত্র তিন শতাংশ সরকার বহন করে, ২৪ শতাংশ আসে অন্যান্য সূত্র থেকে। অবশিষ্ট অর্থ রোগীকেই বহন করতে হয়।
চিকিৎসাব্যয়ের কোন খাতে কত টাকা খরচ হচ্ছে এবং সেই ব্যয়ের কত অংশ কে বহন করছে এ বিষয়ে ২০১২ সালে একটি গবেষণা হয়। গবেষণার ফল প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। ওই গবেষণা অনুযায়ী চিকিৎসাব্যয়ের ৬৩ শতাংশ রোগীকে বহন করতে হয়। ২৩.৯ শতাংশ সরকার, ৮.৩৫ শতাংশ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এবং ৫.২৫ শতাংশ দাতব্য সংস্থা বহন করে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ব্যয়কৃত ৬৩ শতাংশের মধ্যে ৬৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় ওষুধের জন্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক আসাদুল ইসলাম বলেন, চিকিৎসাব্যয়ের কত শতাংশ কোন খাতে খরচ হয় এ সংক্রান্ত সর্বশেষ জরিপ হয়েছিল ২০১২ সালে এবং প্রকাশিত হয় ২০১৫-এর জানুয়ারিতে। প্রতি দুই তিন বছর পর পরই বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস জরিপ শীর্ষক এই জরিপ প্রকাশ করা হয়। চলতি বছরের আগস্ট মাসেই নতুন আরেকটি জরিপের ফল প্রকাশ হবে।
নতুন গবেষণায় চিকিৎসাব্যয় কত বাড়তে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে আসাদুল ইসলাম বলেন, দিন দিন জীবনযাত্রার ব্যয়সহ সব ধরনের ব্যয় বাড়ছে, চিকিৎসাব্যয়ও বাড়বে। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী চিকিৎসাব্যয়ের ৬৩ শতাংশ রোগী বহন করছে। আগামী কয়েক বছরে এই ব্যয় আরো বাড়াতে পারে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এবং স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা: রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। স্বাস্থ্য ব্যয়ের বেশির ভাগ রোগীকে বহন করতে হয়। চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তিতে দেশে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান দৃশ্যমান। অথচ সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সবাই স্বাস্থ্যসেবা পাবে। স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে কাউকে আর্থিক দৈন্যতার মধ্যে পড়তে হবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) তথ্য উল্লেখ করে তিনি জানান, চিকিৎসাব্যয় মেটাতে বাংলাদেশে বছরে ৩.৪ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। ১৫ শতাংশ পরিবার অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এই অবস্থায় সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা কতটা সম্ভব তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণায় ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ের ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু খরচের এই হার কত শতাংশ হলে সহনীয় পর্যায়ের হবে এর উল্লেখ নেই। বলা হয়, স্বাস্থ্যসেবা পেতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় রোগীকে তার ৩০ শতাংশের কম খরচ করতে হলে সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। অথচ আমাদের দেশে চিকিৎসা পেতে ব্যয়িত অর্থের ৬৩ শতাংশই রোগীকে বহন করতে হচ্ছে। নতুন জরিপের যে ফল প্রকাশ হবে তাতে খরচের এই হার বাড়বে বৈ কমবে না। বলাই যায় যে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমরা অনেক দূরেই আছি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক অধ্যাপক ডা: মোজাহেরুল হক বলেন, মানুষ সরকারি হাসপাতালে গিয়ে ঝামেলা পোহাতে রাজি নয়। আগে নানা কারণে মানুষ চিকিৎসকের কাছে যেত না এখন যায়। নিত্যনতুন আবিষ্কারের ফলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ বেড়েছে। তবে পকেট থেকে চিকিৎসা বাবদ ব্যয়িত অর্থের বেশির ভাগই খরচ হয় ওষুধের পেছনে। চিকিৎসকেরা চিকিৎসাপত্রে দামি ওষুধ দিচ্ছেন। ওষুধের দাম নির্ধারণ এবং বিষয়টি মনিটর করা, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করা, অপ্রয়োজনে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করতে ‘ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল’ থাকলে চিকিৎসাব্যয় কমে আসবে।