আমি দ্রুত ওড়না কেটে মেয়েকে নিচে নামিয়ে খাটের ওপর শুইয়ে দিই। ওর জিহ্বা বের করা ছিল আর চোখগুলো কেমনভাবে যেন তাকানো অবস্থায় ছিল। আর এই ওড়না আমি সিঙ্গাপুর থেকে কিনে এনেছিলাম। আমার মেয়ে সাজতে অনেক পছন্দ করত। ও একটি ওড়না চেয়েছিল, যা ও সব ড্রেসের সঙ্গে পরতে পারবে। আমি সিঙ্গাপুর থেকে ওই ওড়না এনে দিই। ওই ওড়নাতেই সে চিরতরে চলে যাবে এমন জানলে কখনই আনতাম না। কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা বলছিলেন বাবা সুব্রত। রাজধানীর ধানমণ্ডির সেন্ট্রাল রোডের ৪৪ নম্বর বাসার ৫বি ফ্ল্যাটের বাসা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে স্বর্ণার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। এ সময় বাবা আরও জানান, যে ঘরে সে আত্মহত্যা করে ওই ঘরের টেবিলে একটি সুইসাইড নোট পেয়েছি। সেখানে লিখা আছে, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। মৃত্যুর আগে এভাবে সুইসাইড নোটে বড় বড় করে লিখে গেছে রাজধানীর ফার্মগেটে অবস্থিত হলিক্রস স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা।
আর এই লেখাটির ঠিক পাশেই ছিল একটি হাসির চিহ্ন আঁকা, যা থেকে ধারণা করা হচ্ছে এটি ব্ল– হোয়েল গেমসের ৫০ নম্বর ধাপ। ওই গেমের প্রভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে মেধাবী ছাত্রী অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা। মেধাবী অপূর্বা বর্ধন রাজধানীর ওয়াইডব্লিউসিএ হায়ার সেকেন্ডারি গার্লস স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল। সেখানে সব সময় মেধাতালিকায় প্রথম ছিল স্বর্ণা। এরপর ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয় ফার্মগেটের হলিক্রস স্কুলে। এরপর থেকেই তার পরিবারের সন্দেহ তাদের মেয়ে ‘ব্লু হোয়েল’ গেমে আসক্ত হয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তবে পুলিশ এবং নিহতের ফুফুর দাবি, সে ব্লু হোয়েলের প্রভাবে নয় সে ফ আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণ করেছে।
স্বর্ণার বাবা আইনজীবী সুব্রত বর্ধন জানিয়েছেন, স্বর্ণা যেদিন আত্মহত্যা করে সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। সাধারণত স্বর্ণার ঘরের লক লাগানো থাকত না। ওইদিন ভোর ৬টার দিকে ওর মা ঘুম থেকে ওঠার পর তার রুমের লক লাগানো দেখতে পায়। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। পরে সে চাবি দিয়ে দরজা খোলে। এরপর দরজা একটুখানি খুলেই মেয়েকে ফ্যানের সঙ্গে গলায় নাইলনের ওড়নায় পেঁচানো অবস্থায় ঝুলতে দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। আমি ছুটে গিয়ে দেখি, খাটের ওপর বসানো একটি চেয়ার পড়ে আছে। চেয়ারটি খাটের পশ্চিম পাশে নিচে পড়লেই কাজের মেয়েটি জেগে উঠত। তা যাতে না হয় এবং কোনো শব্দ যাতে না হয়, সে জন্য বিছানার ওপর ফেলা হয়েছে চেয়ারটি।
সুব্রত বর্ধন জানান, মেয়ের লাশ উদ্ধারের দিনই শুনতে পান ‘ব্ল–হোয়েল’ নামে একটি সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর গেমের কথা। তিনি দাবি করছেন, ওই গেমে অংশ নিয়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তার মেয়ে।
সুব্রত বলেন, তবে আমার মেয়ের মুখে কোনোদিন আমি এই ব্ল–হোয়েল গেমটির নাম শুনিনি। কেবল লক্ষ করতাম যে, রাত জেগে সে ফোন ব্যবহার করত আর কিছুদিন থেকে ও শুধু ছাদে যেতে চাইত। রাত ১১টার পর অনেকবার আমি নিজেই তাকে ছাদে নিয়ে গেছি। পূর্ণিমার চাঁদ তার খুব পছন্দ ছিল।’
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা জব্বার যুগান্তরকে বলেন, এটি মূলত গেমস নয়, একজন ক্যাপ্টেন পেছন থেকে এটি পরিচালনা করে। এর মোট ৫০টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। ৫০তম ধাপে গিয়ে বলা হয়, আত্মহত্যা করতে। আর প্রতিটি ধাপেই ব্যবহারকারীকে একটি করে চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়। কোনো মানুষ এ ধরনের ঘটনার শিকার হোক বা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকুক, এটা কেউ চায় না। আমাদের এখানে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিয়ে যদি এটি ঢুকে, তবে জাতীয়ভাবে এর গেটওয়ে বন্ধ করে দেয়া উচিত। ভারতে এরই মধ্যে যেসব এলাকায় এর লিংক আছে, তা মুছে দেয়া হয়েছে বা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকারের অবশ্যই এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। কারণ ইন্টারনেটের গেটওয়ে সরকারের হাতে। আমরা শুধু সচেতনতা বাড়াতে পারব। এটি ব্লক করে দেয়ার চাবি সরকারের হাতে। তবে মেয়েটির মৃত্যু ব্ল–হোয়েল গেমের প্রভাবে নয় বলে দাবি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন নিহত অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণার ফুফু।
কেয়া চৌধুরী জুই নামে ওই নারী নিজেকে স্বর্ণার ফুফু দাবি করে তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, বলা হচ্ছে মেয়েটি ব্লু হোয়েল গেমের ভিক্টিম। তারই জের ধরে সে নাকি বৃহস্পতিবার কোজাগরী লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে ঝুলে পড়েছে তার পড়ার ঘরের সিলিং ফ্যানে। একটি নিখুঁত সুইসাইড। ওই ফুটফুটে ১৪ বছর বয়সী বাচ্চাটা আমার ভাতিজি। বাচ্চাটাকে আমি নিজে হাতে শেষ স্নান করিয়েছি। ওর গায়ে সামান্য কোনো কাটা ছেড়ার দাগও ছিল না, ছিল না কোনো ট্যাটু। ওর ফোন ঘেঁটেও পাইনি এমন কোনো প্রমাণ যার জেরে বলা যায় ও ব্ল–হোয়েল খেলতে শুরু করেছিল। সবকিছু দেখে-শুনে বুঝতে পারি যে, সন্দেহটা একদমই ভিত্তিহীন।
একই দাবি করেছে পুলিশও। নিউমার্কেট থানার ওসি আতিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মৃত্যুর সঙ্গে ব্ল–হোয়েল কোনো প্রভাব পাওয়া যায়নি। মূলত বিষণ্ণতা এবং হতাশা থেকে সে আত্মহত্যার মতো পথ বেঁচে নিয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিউমার্কেট থানার এসআই মাহমুদ সিরাজী বলেন, লাশ সুরতাহাল শেষে পরিবারের চাহিদানুযায়ী ময়নাতদন্ত না করে লাশ দিয়ে দেয়া হয়েছে। আত্মহত্যায় মৃত্যু হয়েছে সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তবে ব্ল–হোয়েলের যে সিমটম থাকার কথা সুরতহাল রিপোর্টে সেটি ছিল না।