দুর্নীতির সুনামি চালিয়ে রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)- তে এখনও বহাল তবিয়তে এমডি আবুল হোসেন

(প্রথম পর্বঃ)
এক্সক্লুসিভঃ-
বিগত সরকারের আমলে আমরা জেনেছি, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান কে হবেন তা ঠিক করে দিত ভারত। শুধু তাই নয়, এদেশের সংসদ সদস্য মন্ত্রী নির্বাচন- সবই নিয়ন্ত্রিত হত ভারত থেকে। বাংলাদেশের ব্যাংক-বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা তখন সবকিছুই ভারতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল না। এর মাঝে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির দিকে, সেটা হলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ বা আইসিবি। এটি শুধু ভারতের RAW বলয়ের পছন্দের লোকবল দ্বারা সুবিধা ভাগ-বাটোয়ারায় লিপ্ত একটি প্রতিষ্ঠানই ছিল না, এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ, এখানে ইসকনের সরাসরি সুপারিশ মতো কে-কোথায় পদায়ন ও পদোন্নতি হবে তাও নির্দেশিত হতো। এছাড়া বিগত ১৫ বছরে দুর্নীতির দায়ে যতজনের বিরুদ্ধে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন)-এ অভিযোগ দায়ের ও মামলা হয়েছিল, অভিযোগ আছে, এই বলয়ের প্রভাবের কারণে দুদক অভিযুক্ত ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে ‘ক্লিন’ সার্টিফিকেট প্রদান করে। ফলে আইসিবি’র সেইসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা আরও উৎসাহিত হয়ে দুর্নীতির সাগর-মহাসাগর রচনা শুরু করে দেয়।
এইজন্য সাধারণ মানুষের অভিমত , বাংলাদেশের দুদককে সকল প্রভাবিত বলয় থেকে মুক্ত করা দরকার। এবং এই সংস্থার কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিরুদ্ধে যদি অসদাচারণ কিংবা দুর্নীতির অভিযোগ উঠে তবে নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দুদকের এই সকল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। উপরোল্লিখিত এই সকল গুরুতর অভিযোগুলো সত্য কি-না বর্তমান দেশের বিপ্লবী সরকারের সকল রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর খতিয়ে দেখা দরকার।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইসিবি শুধু মাত্র একটি রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানই নয় বরং এর সাথে জড়িত হয়ে আছে দেশের ৩৩ লক্ষ ক্ষুদে শেয়ার বিনিয়োগকারীদের ভাগ্য ও ভবিষ্যত। মূলত শেয়ার উন্নয়নের জন্যই কাজ করে থাকে আইসিবি। বিগত সরকারের আমলে দেশের ক্ষুদে বিনিয়োগকারীদের জীবন ও জীবিকা লুটে নিতে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে এই আইসিবি’রই কিছু কুলাঙ্গার কর্মকর্তা। এই লুটপাটের সাথে আরও ১৫ বছর ধরে নিয়মিত বিনিয়োগকারীকে পথে বসানো দরবেশ বাবা খ্যাত সালমান এফ রহমান, দেশের বেশির ভাগ সরকারী/বেসরকারী ব্যাংকগুলোকে পথে বসানোর নায়ক এস. আলম গ্রুপ, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী লোটাস কামাল, সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC) এর সাবেক চেয়ারম্যান শিবলি রুবাইয়াত, বিতর্কিত ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেন, শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার নাতি পরিচয় দেওয়া রংপুরের ব্যবসায়ী সালমান তালিব, আইসিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মজিব উদ্দিন আহমেদসহ অন্যান্যরা।
তবে আইসিবি লুটেরাদের মহানায়ক হচ্ছেন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোপালগঞ্জের ফয়েকুজ্জামান এবং বর্তমান মাদারীপুরের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব আবুল হোসেন। শুধুমাত্র লুটপাট করার সুবিধার্থে আইসিবি’র সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোপালগঞ্জের ফয়েকুজ্জামান ওয়াসার মহা-দুর্নীতিবাজ তাকসিমের মতো নিজেকে ছয়-ছয়বার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়ে আইসিবি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের বহু অভিযোগ আছে। বারবার তাঁর মেয়াদ বাড়ানোটা ছিল হাস্যকর ও বিতর্কিত। গোপালগঞ্জ বাড়ি হওয়াতে তিনি কোনো প্রকার আইন কানুনেরই তোয়াক্কা করতেন না। ছয়বারের পর এরপর এখানে সুযোগ ও সুবিধামতো ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে দিয়ে নিয়ে আসেন মাদারীপুরের সিস্টেম এনালিষ্ট আবুল হোসেনকে।
বিগত সরকারের আমলে এই ফয়েক ও আবুল হোসেন মিলে দেশের বিতর্কিত সব সালমান, এস আলম লুটেরাদের নিয়ে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে একেবারে খাদের কিনারে নিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতির সুনামি চালিয়ে এখনও রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইসিবি-তে বহাল তবিয়তে আছেন মাদারীপুরের এমডি আবুল হোসেন।
শুধুমাত্র আইসিবি’র নিজস্ব পোর্টফোলিওর শেয়ার ১৮,০০০ (আঠার হাজার) কোটি টাকার ভালো ভালো শেয়ারসমূহ একক সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC) এর সাবেক চেয়ারম্যান শিবলি রুবাইয়াতের সাথে যোগসাজসে বিক্রি করে প্রচুর টাকা আত্মসাত করেন। ফলে বর্তমান পোর্টফলিও এর মূল্য অর্ধেক ৯০০০/- (নয় হাজার) কোটি টাকায় নামিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে দেউলিয়ার শেষ প্রান্তে ছেড়েছেন। এই রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকা শেয়ারের টাকার মালিক জনগণ কিন্তু এই লুটেরা তাতে বিন্দুমাত্র পরোয়া করে নাই।

এদিকে বেক্সিমকো লিঃ ও বেক্সিমকো ফার্মার হাজার কোটি টাকার বিপুল সংখ্যক শেয়ার ব্লক ট্রেডের মাধ্যমে সালমান এফ রহমানের কাছে যোগসাজসে বিক্রির মাধ্যমে প্রচুর পরিমান অর্থ তিনি আত্মসাত করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এছাড়া ৩০০০ কোটি টাকার বেক্সিমকো সুকুকের বিধিবহির্ভূতভাবে আইসিবি ট্রাস্টি প্রদান করার মাধ্যমে প্রচুর অর্থ আত্মসাতের বিনিময়ে আইসিবিকে তিনি দুর্বল করে দিয়েছেন।
নিজের দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে তিনি আরো বড় দুর্নীতির কাজ করে বসেন। তিনি তাঁর খালাতো, মামাতো, ফুফাতো, চাচাতো ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ের শ্বশুর পক্ষের আত্মীয় স্বজনসহ প্রায় ৫৫-৬০ জন লোকবলকে আইসিবি ও এর ৩টি সাবসিডিয়ারি কোম্পানীতে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে রেখেছেন এবং তাদের থেকে নিয়মিত সুবিধাও গ্রহণ করছেন। সবাইকে বঞ্চিত করে এই অবৈধ কর্মকর্তাদের আবার অবৈধভাবে নিয়মিতভাবে পদোন্নতি এবং স্পর্শকাতর জায়গায় পদায়ন করে রেখেছেন।
এদের সবারই বাড়ি মাদারীপুর ও তদসংলগ্ন এলাকায়। দেশের বেশিরভাগ জাতীয় পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে কিন্তু আবুল হোসেন সেই প্রভাব বলয়ের শক্তির কারণে এই বিষয়ে তিনি থোড়াই কেয়ার করছেন। দেশের প্রতিটি সরকারী ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সকল সরকারী অফিসের বিগত সরকারের ফ্যাসিস্টদের বিতারণ করা গেলেও এখানে এখনও বহাল তবিয়তে আছেন তিনি। শুধু তিনিই নন, বিগত সরকারের ১৫ বছরে লাখ লাখ কোটি টাকা গায়েব করে দেয়া তাঁর সাথের অন্যান্য খলনায়ক কর্মকর্তারা এখনও আইসিবিতে বহাল তবিয়তে আছেন।
সারাদেশে সরকারী প্রতিষ্ঠানে মোট জনবলের সংখ্যা প্রায় ২৩/২৪ লক্ষ প্রয়োজন হলেও দপ্তরগুলো ১৩/১৪ লক্ষ লোকবল দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু আইসিবি ও আইসিবি’র অধীনস্থ ৩টি সাবসিডিয়ারি কোম্পানীতে লোকবলের কোনো ঘাটতি নেই। আইসিবি’র দুর্নীতিবাজ খলনায়কদের বুদ্ধিতে নতুন নতুন পদ সৃষ্টির মাধ্যমে অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যকে অনুমতি দিচ্ছেন আবুল হোসেন।
২০০১ সাল থেকে আইসিবি’র মূল কাজ ছিল- সেতু ঋণ, বিনিয়োগ হিসাব, মিউচুয়্যাল ফান্ড এবং ইউনিট ফান্ড এর কাজ কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে প্রকল্প ঋণ বন্ধ করে দেবার মাধ্যমে পূর্বের দেয়া প্রকল্প ঋণের সুদ মাফ ও কিস্তির টাকা রি-সিডিউল করার মহাউৎসবের নামেও চলছে দুর্নীতি। ফলে আইসিবি’র মুল কাজ বন্ধ থাকায় প্রধান কার্যালয়সহ ৭টি কার্যালয়ে কাজের মন্দাভাব বিরাজ করছে।
আইসিবিতে বঙ্গবন্ধু পরিষদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের কয়েকজন এবং তাকে সর্বাত্মক সহযোগীতার অভিযোগ রয়েছে যথাক্রমে- বাবুল চন্দ্র দেবনাথ, বিভাস সাহা, তাপস ঢালী ও বিপ্লব কুমার সাহা এবং গোপালগঞ্জের জিএম মফিজের বিরুদ্ধে। এছাড়াও তিনি আইসিবি’র কর্মকর্তা সমিতি, কর্মচারী ইউনিয়নে খুবই কৌশলে নিজস্ব পছন্দের লোককে সিলেকশন ও ইলেকশনের মাধ্যমে বসিয়ে তাঁর পাপের ক্ষেত্র নিরাপদে রেখেছেন। এই জন্য প্রতিবছর পিকনিকের নামে মাত্র ৬৫০ জন লোকের বিপরীতে এমন দু:সময়ে ১ কোটি ষাট লক্ষ টাকা পিকনিক বাজেট প্রদানের মাধ্যমে ভাগ বন্টনে নিজের সুবিধা ও স্বার্থ হাসিল করেছেন। তিনি দলীয় ও বিশেষ অঞ্চলের মানুষ ব্যতিত এবং তাঁর ক্ষমতা ও অহংকারে তাঁর পূর্বে ও পরে যোগদানকারী অনেক সিনিয়র ও যোগ্য কর্মীদের অপমান, অসম্মান ও অবমূল্যায়ন করার কারণে অবসর যাবার আগেই ইতোমধ্যে অনেক যোগ্য-কর্মকর্তাগণ স্বেচ্ছায় চাকুরী ছেড়েছেন, ছাড়ছেন এবং ছাড়ার দিনক্ষণ গুনছেন।
জনাব আবুল হোসেন ও সাবেক এমডি ফয়েকুজ্জামানের দুর্নীতির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আইসিবিতে গড়ে উঠেছে এক বিশাল সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট মহাউৎসবে এখনও বহাল তবিয়তে সমানে দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে।
আবুল হোসেন নিজে ছিলেন সিস্টেম এনালিস্ট। তাই অধিকতর নবীণ, অযোগ্য ও কম্পিটার টেকনেশিয়ানদের সাথে কাজে আগ্রহী, যেমন- আবুল হোসেন শুভ, শেখ আসলাম, মাহাবুব, রফিক, হাবিবুল্লাহ এবং গোপালগঞ্জের জিএম মফিজুল ইসলামকে বিশেষ কোঠায় একইভাবে মেকানিজম করে এজিএম, ডিজিএম এবং জিএম পদে পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনিক ও শাখা কার্যালয়ে কাজের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রশাসনিক জায়গাগুলোতে রেখেছেন।
আবুল হোসেন আইসিবি’র ইসলামী ব্যংকের ধারণকৃত স্পন্সর শেয়ার যোগসাজসে এস. আলম গ্রুপের কাছে বিক্রি করে বিপুল পরিমান অর্থ আত্মসাৎ করে আইসিবিকে দুর্বল প্রতিষ্টানে রূপান্তর করে ফেলেছেন।
আবুল হোসেন এবং তাঁর সাথের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজসে ফরচুন সুজের শেয়ার কিনে প্রায় ৫০ কোটি টাকার বড় লোকসানে এখন আইসিবি।জেনেশুনে তুলনামূলক দূর্বল মৌলের এসব শেয়ার উচ্চ মূল্যে কিনেছিল আইসিবি। অভিযোগ আছে, কারসাজিকারীদের সুবিধা দিতে তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এসব শেয়ার কিনেছিল তারা।এই কাজে নানা অনিয়মের বেড়াজালে আটকা পড়া ডিজিএম ফারুক আলম চাকুরী থেকে ইস্তাফা দিয়ে এখন দেশ ছাড়ার চেষ্টায় আছেন।ফারুক আলমের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে, এমডির আস্থাভাজন হিসেবে তারা শেয়ারের কারসাজির মাধ্যমে অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
এদিকে বিতর্কিত ব্যবসায়ী নাফিজ সরাফাতকে জালিয়াতি করে গোপনে শেয়ার কিনে দেয় আইসিবি। ফলে সরকারি National Tea Company এখন প্রায় দখলবাজদের হাতে।
আইসিবি থেকে জানা গেছে, বর্তমানে নতুন এমডি খোঁজার কাজ শুরু হয়ে গেছে। দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের পছন্দ, কুমিল্লার কেউ হলে ভালো হয় নতুবা আগের অবসরপ্রাপ্ত এমডি বা ডিএমডিকে এখানে আনার প্রচেষ্টা চলছে। এই বিষয়কে সরকারকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। যাতে খাদের কিনারায় চলে যাওয়া আইসিবি নামের এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে সকল প্রকার প্রভাব বলয়ের কাছ থেকে মুক্ত করা যায়।
পরবর্তীতে কিস্তিতে ছবির উল্লেখিতদের সাথে এমডি আবুল হোসেনের অন্যান্য অপরাধগুলো বিশদ এবং আইসিবি-তে তাঁর সাথে যে সকল বর্তমান কর্মকর্তা/কর্মচারী এখনো অন্যায়-অনিয়ম করে চলছেন সেই সব লুটেরাদের নিয়ে দুর্নীতির বয়ান প্রকাশিত হবে।
(চলবে. . .)