ইসলাম ধর্ম

শাবান মাসের ফজিলত ও গুরুত্ব:-হাদিসের আলোকে করণীয়…

(মুফতি আলী হুসাইন)

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান ছাড়া শাবান মাসে সর্বাধিক রোজা রাখতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে পূর্ণ মাস রোজা রাখতে দেখিনি। আর আমি তাঁকে রমজান ব্যতীত শাবান মাস অপেক্ষা এত অধিক পরিমাণে রোজা রাখতে আর কোনো মাসে দেখিনি। (সহীহ বুখারি, হাদীস ১৯৬৯)

অপর এক বর্ণনায় আয়েশা (রা.) বলেন-

রোজা রাখার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সর্বাধিক প্রিয় মাস ছিল শাবান মাস। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ২৪৩১)

উপরিউক্ত হাদিস দুটি দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, শাবান মাসে রোজা রাখা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় ছিল। আর এ জন্যই তিনি রমজান মাসের পর সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রোজা রাখতেন এ মাসে।

শাবানের রোজার নিগূঢ় রহস্য : আল্লামা তাবারি (রহ.) শাবানের রোজা তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ার ছয়টি উল্লেখযোগ্য কারণ বর্ণনা করেছেন, তন্মধ্যে চারটি বিষয় সম্পর্কে হাদিসে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। ( উমদাতুল কারি: ১১/১৩৩)

নিম্নে সংক্ষিপ্ত আকারে আলোকপাত করা হলো।

▪️এক. শাবান মাসে আল্লাহর কাছে আমল পেশ করা হয়-
স্বভাবতই আমাদের জানতে ইচ্ছা হয় যে, শাবান মাসে প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতবেশি রোজা রাখতেন কেন? সাহাবিদের মনেও এমন প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছিল। তারা রাসুলুল্লাহকে উক্ত মাসের তাৎপর্য সম্পর্কে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছেন।

উসামা বিন যায়েদ (রা.) বলেন, আমি একদিন নবিজিকে বললাম-

শাবান মাসে আপনাকে যে পরিমাণ রোজা রাখতে দেখি অন্য কোনো মাসে এতবেশি রোজা রাখতে কখনো দেখিনি। (এর রহস্য কী?) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

শাবান হলো রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী মাস। এ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে মানুষ উদাসীন থাকে। এ মাসে মহান রাব্বুল আল্লাহর কাছে আমল পেশ করা হয়। আমি এটা পছন্দ করি যে, রোজাদার অবস্থায় আমার আমল (আল্লাহর দরবারে) পেশ করা হোক। ( সুনানে নাসায়ী, হাদিস ২৩৫৭)

▪️দুই. রমজানকে স্বাগত জানানো এবং মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ-
শাবানের রোজা রাখার অর্থ হলো রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করা, রমজানকে স্বাগত জানানো। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার জন্য নিজের দেহ ও মনকে প্রস্তুত করা। আনাস (রাদি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, রমজান মাসের পর সর্বোত্তম রোজা কোনটি? তিনি বলেন, রমজানের সম্মানার্থে শাবান মাসের রোজা সর্বোত্তম। ( তিরমিযি: ১/১৪৪)

রমজানের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব, মানসিক প্রস্তুতি, শারীরিক ও আত্মিক শক্তি উৎপাদন, রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের ফুরসত এবং বিপুল পরিমাণ নেকি অর্জনের মানসিকতা সৃষ্টি হয় এই শাবান মাসে। সহজ কথায় নফল নামাজ যেমন ফরজ নামাজের সম্পূরক তদ্রূপ শাবানের রোজাও রমজানের ফরজ রোজার সম্পূরক। ( মাআরিফুল হাদিস: ৪/১৫৫; লাতায়েফুল মাআরিফ: ১/১৩৮)

▪️তিন. আগত বছর যারা মারা যাবে তাদের নাম মালাকুল মাওতের নিকট হস্তান্তর করা হয়-
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি শাবান মাসে এত বেশি রোজা রাখেন কেন? তিনি উত্তর দিলেন, আগামী বছর যাদের মৃত্যু হবে, এ মাসে তাদের নাম মালাকুল মাওতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অতএব আমি এটা পছন্দ করি যে, রোজা অবস্থায় আমার নাম পেশ করা হোক। ( মুসনাদে আবি ইয়ালা: ৪৯১১; ফাতহুল বারি: ৪/২৫৩)

▪️চার. প্রত্যেক মাসের তিন দিনের রোজা এই মাসে আদায় হয়ে যায়-
এটা একটি উল্লেখযোগ্য কারণ যে, রাসুলুল্লাহ প্রত্যেক মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের রোজা রাখতেন। কিন্তু অনেক সময় সফর বা অন্য কোনো কারণে এ দিনের রোজাগুলো তাঁর ছুটে যেত, তাই তিনি শাবান মাসে অন্যান্য মাসের ছুটে যাওয়া রোজাগুলোর কাজা করে নিতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ প্রত্যেক মাসের তিন দিন রোজা রাখতেন। কখনো এই রোজাগুলো ছুটে যেত, ফলে পুরো বছরের রোজা বাকি থাকত, তাই তিনি শাবান মাসে ছুটে যাওয়া রোজাগুলোর কাজা করে নিতেন। (নাইলুল আওতার: ৪/৩৩১)

কোরআন-হাদিসের আলোকে রমজান মাসের যেমন গুরুত্ব রয়েছে, জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব মাসের যেমন গুরুত্ব রয়েছে, ঠিক তেমনি বান্দার আমলের বাৎসরিক রিপোর্টের মাস হিসেবে শাবান মাসের গুরুত্বও কম নয়। রাসুলুল্লাহ শাবানের অধিকাংশ দিন রোজা রেখেছেন। তাই এ মাসে অন্যান্য নেক আমলের পাশাপাশি সামর্থ্য অনুযায়ী রোজা রাখার চেষ্টা করা উচিত। অবশ্য রোজা রাখবে শাবান মাসের ২৭ তারিখ পর্যন্ত হাদিসে রমজানের এক-দুই দিন আগে রোজা রাখতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯১৪)

▪️আমাদের প্রাত্যহিক ও সাপ্তাহিক এবং বাৎসরিক আমলের রিপোর্ট-
প্রতিদিন আমাদের আমলনামা মহান আল্লাহর কাছে উপস্থিত করা হয়। দিনের আমলনামা রাতে আর রাতের আমলনামা দিনে পেশ করা হয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৭৯)

প্রতি সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার আল্লাহর কাছে বান্দার আমলনামা পেশ করা হয়। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ এ দুই দিনের রোজার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করতেন।

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়ে থাকে। কাজেই আমি এটা পছন্দ করি যে, রোজাদার অবস্থায় আমার আমলগুলো আল্লাহর দরবারে পেশ করা হোক। (তিরমিযী : ৭৪৭)

আয়েশা (রা.) বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতেন। (নাসাঈ : ২৩৬০; তিরমিযী : ৭৪৫)

আর প্রতিবছর শাবান মাসে একবার আমলনামা পেশ করা হয়, এটা হলো বাৎসরিক রিপোর্ট, যা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে। (লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃ: ২৪৪)

▪️অর্ধ শাবানের রাত বা শবে বরাত-
অর্ধ-শাবানের রাত তথা চৌদ্দ তারিখের রাতটি অত্যন্ত তাৎপর্যময়। এ রাতকে সাধারণ মানুষ শবেবরাত বলে অভিহত করে কিন্তু হাদিসের ভাষায় বলা হয় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ অর্থাৎ অর্ধ-শাবানের রাত। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ রাতের ফজিলত প্রসঙ্গে বলেছেন, মহান আল্লাহ অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি (রহমতের) দৃষ্টি দেন; অতঃপর তিনি তার সব সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন, কিন্তু শিরককারী ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারীকে ক্ষমা করেন না। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস ৫৬৬৫; বাইহাকী হাদিস ৩৮৩৩)

উপরিউক্ত হাদিসটি নির্ভরযোগ্য ও আমলযোগ্য। ইমাম ইবনে হিব্বান, ইমাম যাকিউদ্দীন মুনযিরী, যাইনুদ্দীন ইরাকী প্রমুখ হাদিস বিশারদ ইমামগণ হাদিসটিকে নির্ভরযোগ্য বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। আততারগীব ওয়াত তারহীব ২/১১৮; শরহুল মাওয়াহেব ৭/৪১২)।

শায়েখ নাসির উদ্দিন আলবানি (রা.) বলেন, অর্ধ-শাবানের রাতের ফজিলত প্রসঙ্গে প্রায় ৮ জন সাহাবি থেকে বিভিন্ন সূত্রে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সবগুলো সনদ পর্যালোচনা করে তিনি বলেন, এ সমস্ত সনদের মাধ্যমে হাদিসটি নিঃসন্দেহে সহিহ এবং আমলযোগ্য। (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহিহাহ: ৩/১৩৫)

সুতরাং উল্লেখিত বর্ণনা অনুযায়ী প্রতীয়মান হয় যে, অর্ধ-শাবানের রাতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সব মুমিনের জন্য রহমত ও মাগফিরাতের দরজা উন্মুক্ত করা হয়। তবে যারা শিরকে লিপ্ত এবং অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে আল্লাহ তাদের এ রাতে ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া সবাই এই রাতে মাগফিরাত ও রহমত প্রাপ্ত হয়।

উপর্যুক্ত হাদিস ও অন্যান্য হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী যেহেতু এ রাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষভাবে গুনাহ মাফের ঘোষণা রয়েছে। তাই গুনাহ মুক্তির রাত হিসেবে এ রাতকে শবেবরাত তথা ‘মুক্তির রজনী’ নামে অভিহিত করা হয়। কাজেই এ রাতে গুনাহ মুক্তির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা কাম্য। পাশাপাশি অধিক নেক আমল ও দীর্ঘ রুকু-সিজদাবিশিষ্ট নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত এবং দোয়া-ইস্তিগফারের মাধ্যমে আল্লাহর মাগফিরাত ও রহমত লাভের ঐকান্তিক চেষ্টা করাও কর্তব্য। মনে রাখতে হবে, এই রাতকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোনো ইবাদত নেই। বরং কোরআন-হাদিসে বর্ণিত সাধারণ নফল ইবাদতগুলোই এ রাতে অধিক পরিমাণে করার চেষ্টা করবে। কেননা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ক্ষমা ও রহমত প্রাপ্তি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button