সারাদেশে এক সময়ে জুমার নামাজ—ঐক্য ও শৃঙ্খলার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ

বিল্লাল বিন কাশেমঃ সপ্তাহের দিনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র ও ফজিলতপূর্ণ দিন হচ্ছে শুক্রবার। এই দিনটির গুরুত্ব ইসলামে এতটাই মর্যাদাপূর্ণ যে, একে ‘সপ্তাহের ঈদ’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। মুসলিম সমাজে এই দিনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো জুমার নামাজ।
মহান আল্লাহ তাআলা নিজ বাণীতে জুমার নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, “হে ঈমানদারগণ! জুমার দিনের নামাজের আজানের আহ্বান শুনলে তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা পরিত্যাগ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে।” (সুরা জুমা, আয়াত ৯)
এই নির্দেশনাটি শুধু একটি ধর্মীয় আদেশই নয়, বরং মুসলিম সমাজে পারস্পরিক ঐক্য, সৌহার্দ্য ও শৃঙ্খলার একটি প্রতীকও বটে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে জুমার নামাজের সময়সূচি বিষয়ক একটি বিশৃঙ্খলা দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যমান। কোনো মসজিদে জুমার নামাজ শুরু হয় দুপুর ১টা, কোথাও ১টা ৩০ মিনিটে, আবার কোনো কোনো জায়গায় শুরু হয় ১টা ৫০ মিনিটে। এই সময়ের তারতম্য শুধু মুসল্লিদের মধ্যেই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে না, বরং ধর্মীয় ঐক্যবোধ ও শৃঙ্খলাকেও ব্যাহত করে।
বিশেষ করে সফররত মুসল্লি বা পথচারীরা এই বিভ্রান্তির মুখে পড়েন প্রায়ই। তারা কখনো এক মসজিদে গিয়ে নামাজ শেষ হতে দেখে, আবার অন্য মসজিদে গিয়ে অপেক্ষায় থেকে অপ্রয়োজনীয় সময় নষ্ট করেন। শুধু তাই নয়, একই এলাকার মসজিদগুলোতেও সময়ের এই ভিন্নতা চোখে পড়ে। এতে সামগ্রিকভাবে সমাজে একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়, যা মোটেও কাম্য নয়।
জুমার নামাজের সময়সূচির এই তারতম্য দূর করার মাধ্যমে আমরা একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও ঐক্যবদ্ধ মুসলিম সমাজ গড়ে তুলতে পারি। এক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রস্তাব অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত—সারাদেশে সকল মসজিদে একযোগে দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে জুমার নামাজ আদায়ের আহ্বান।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন একটি কেন্দ্রীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশে ইসলামিক কার্যক্রম ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বহু বছর ধরে কাজ করছে। দেশের ধর্মীয় ঐক্য ও শৃঙ্খলা রক্ষায় এই প্রস্তাব নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। এর মাধ্যমে শুধু সময়ের একতা নয়, বরং একটি মানসিক ঐক্যও গড়ে উঠবে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে।
এমনিতে আমরা জানি, ইসলামে জামাতের গুরুত্ব অপরিসীম। জামাতে নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানোর যে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষা, তা জুমার নামাজে সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিফলিত হয়। এখন ভাবুন, শুধু জামাত নয়, যদি পুরো দেশের সব মসজিদে এক নির্দিষ্ট সময়ে একসাথে জুমার নামাজ শুরু হয়, তাহলে তা মুসলিম সমাজের জন্য কেমন এক অনুপম সংহতির ছবি ফুটিয়ে তুলবে!
তাছাড়া এক সময়সূচিতে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে পথচারী, সফররত কিংবা নতুন এলাকায় আগত যে কোনো মুসল্লির জন্য নামাজের সময় বুঝে নেওয়া সহজ হবে। এতে মসজিদভিত্তিক সময় বিভ্রান্তি দূর হবে এবং মুসলিমদের জন্য একটি সুশৃঙ্খল সময় ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠবে। এর প্রভাবে সমাজে ধর্মীয় শৃঙ্খলা আরও সুসংহত হবে।
আরেকটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেহেতু জুমার খুতবা হলো মুসলিম উম্মাহকে সাপ্তাহিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার একটি উত্তম মাধ্যম, তাই যদি এক সময়ে সব মসজিদে নামাজ হয়, তখন জাতীয়ভাবে বা স্থানীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর একযোগে মুসল্লিদের অবহিত করা আরও সহজ হবে। এর ফলে সমাজ গঠনমূলক বার্তা সমন্বিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।
বস্তুত, এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জ থাকলেও তা জয় করা অসম্ভব কিছু নয়। নামাজের নির্ধারিত সময় (যোহরের) মধ্যে থেকেই জুমার নামাজ আদায় করা হয়, তাই দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সামান্য তারতম্য বিবেচনায় নিয়ে সময় নির্ধারণ করলে কোনো সমস্যাই থাকার কথা নয়। উদাহরণস্বরূপ, অনেক দেশেই সরকারিভাবে একটি সময় নির্ধারণ করা হয় এবং সব মসজিদ সেই সময়ের মধ্যেই নামাজ শুরু করে। এতে মুসল্লিদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও শৃঙ্খলা তৈরি হয়।
বাংলাদেশে এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে সামগ্রিকভাবে ধর্মীয় পরিবেশ আরও শৃঙ্খলাপূর্ণ হবে, মুসল্লিরা সময় নিয়ে প্রস্তুত হতে পারবেন এবং অযথা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়তে হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, ইসলামি ঐক্যের একটি দৃশ্যমান প্রতীক হয়ে উঠবে এই উদ্যোগ।
সবশেষে বলতেই হয়, জুমার নামাজ কেবল এক ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং মুসলিম সমাজের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটি বিশাল উপলক্ষ। আমরা যদি সময়ের এই বিভ্রান্তি দূর করতে পারি, তাহলে জুমার প্রকৃত মর্যাদা রক্ষা হবে, মুসল্লিদের জন্য সুবিধা নিশ্চিত হবে এবং আমাদের সমাজে শৃঙ্খলার এক নতুন অধ্যায় সূচিত হবে।
তাই সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং স্থানীয় মসজিদ কমিটির উচিত দ্রুত একযোগে কাজ করে এই সময় নির্ধারণ কার্যকর করা। ইসলামের শিক্ষা ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের স্বার্থে সারাদেশে এক সময়ে জুমার নামাজ আদায় সময়ের দাবিই বটে।
লেখক: কবি, কলামিস্ট ও গণসংযোগবিদ