আন্তর্জাতিক

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২২০ কোটি ডলারের ফান্ড বন্ধ করে দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন

গতকাল ট্রাম্প হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২২০ কোটি ডলার বা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২০০০০ কোটি টাকার ফান্ড বন্ধ করে দিয়েছে কারণ হার্ভার্ড ট্রাম্পের শর্ত মানেনি। ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ই -“হু দি-বিরোধী কর্মকাণ্ড রোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, Diversity, Equity and Inclusion (DEI) প্রোগ্রাম বা ক্রিটিক্যাল রেস থিওরি ( CRT) বাতিল, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের উপর নজরদারি বৃদ্ধি এবং প্রো-প্যা -“লে -স্টাইন ছাত্র সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ করার মতো একাধিক দাবি জানিয়েছিল। হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট অ্যালান গারবার এই দাবিগুলিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় নিজের স্বাধীনতাকে সঁপে দেবে না বা নিজের সাংবিধানিক অধিকারকেও ত্যাগ করবে না”। যেকোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ডানপন্থী সরকারের এই বিরোধ সব দেশেই। বিষয়টা কী বিস্তারিত জানতে হলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে।

২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চোখ রাঙানি শুরু হয়! ট্রাম্প সরকার বলে, হার্ভার্ড যদি তার মত অনুযায়ী না চলে, তবে সরকারি ফান্ড বন্ধ করে দেওয়া হবে। হঠাৎ এত রাগ কেন? মূলত “ক্রিটিকাল রেস থিওরি” (CRT) নিয়ে তীব্র আপত্তি ছিল ট্রাম্পের। কী এই ক্রিটিক্যাল রেস থিওরি? এই থিওরি বলে বর্ণবৈষম্য কেবল ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা আচরণে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সেটা সমাজের আইন, সামাজিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান ও নীতিতেও গেঁথে আছে। অর্থাৎ আমি ব্যক্তিগত ভাবে সাদা চামড়ার বা কালো চামড়ার পার্থক্য না করলেও বর্ণবৈষম্য দূর হয় না। কারণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাদা দের প্রভাব থাকায় কালো রা সুযোগ কম পায়। এটা প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণ বৈষম্য। যেমন আমাদের দেশে দলিতরা ও বর্তমানে সংখ্যালঘুরা প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের শিকার। হার্ভার্ড বরাবর এই তত্ত্বে বিশ্বাসী। তাই আমেরিকার কালো চামড়ার মানুষদের পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের অগ্রাধিকার দেয় ভর্তির ক্ষেত্রে। এটাই একটা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঠিক পদক্ষেপ। তবেই একদিন সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ক্রিটিক্যাল রেস থিওরি পড়ানো ও সে নিয়ে চর্চাও হয় বিভিন্ন পাঠ্যক্রমে। কিন্তু ট্রাম্পের মতে, এই ধরনের পাঠ্যক্রম ছাত্রদের মধ্যে আমেরিকান ইতিহাস নিয়ে ঘৃণা তৈরি করে। ঠিক যেভাবে আমাদের দেশেও ভারতের সামাজিক লড়াই এর ইতিহাস যাতে ছাত্র ছাত্রীরা না শেখে সে চেষ্টা হচ্ছে। ট্রাম্পের মতে বা বলা ভালো ডানপন্থীদের মতে এটা বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গদের অর্থাৎ সাদা চামড়ার লোকেদের দোষী হিসেবে দেখায়। হ্যাঁ সেটাই সত্যি যে একসময় শ্বেতাঙ্গ রা কৃষ্ণাঙ্গ দের উপর অত্যাচার করেছে ঠিক যেমন আমাদের দেশেও উচ্চবর্ণের বা উঁচুজাতের মানুষেরা নিম্নবর্ণের বা নিচুজাতের মানুষের উপর অত্যাচার করেছে। আর সেই ইতিহাস সবার জানা দরকার। ভারতেও, আমেরিকাতেও। কিন্তু আমেরিকায় রক্ষণশীল (conservative) রাজনৈতিক দলের বক্তব্য, এটা শিশুদের মনে “আমেরিকার প্রতি ঘৃণা” তৈরি করে। ভারতেও কট্টর ডানপন্থীদের একই বক্তব্য। কিন্তু হার্ভার্ড এসব যুক্তি মানতে রাজি হয়নি। তারা বলেছে, ইতিহাসের গ্লানি-গৌরব দুটোই শেখানো জরুরি, নাহলে আগামী প্রজন্ম অন্ধ হয়ে যাবে।

যাইহোক, ট্রাম্প সাহেব কিন্তু শুধু এখানেই থেমে থাকেননি। কোভিডের সময় বলেছিলেন, অনলাইন ক্লাস করলে বিদেশি ছাত্রদের ভিসা বাতিল হবে! এর প্রতিবাদে হার্ভার্ড আর MIT একজোট হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয় এবং তারা জিতে যায়। ট্রাম্প সরকারকে ভিসা নীতির ওই সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নিতে হয়। কিন্তু ততদিনে শুরু হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ নিয়ে তুমুল বিতর্ক। কেউ বলছে সরকার ঠিক করেছে, আবার কেউ বলছে শিক্ষা যদি সরকারের নির্দেশে চলে অর্থাৎ সরকার যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা গলায়, তাহলে শিক্ষার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। যে বিতর্ক আজ আমাদের দেশেও।

এরপর ২০২১-এ ক্ষমতায় এলেন জো বাইডেন, আর ছবিটা একেবারে পাল্টে গেল। ফান্ড ফিরল, ক্রিটিক্যাল রেস থিওরির-র ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠল, আন্তর্জাতিক ছাত্রদের ভিসা ইস্যু সহজ হলো আবার সব কিছু আগের মতো। একটা ‘হ্যাপি এন্ডিং’-এর মতো মনে হলেও বিষয়টা সেরকম নয়। ২০২৩ সাল। আমি তখন হার্ভার্ডে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছাত্র ছাত্রীরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে সারা বিশ্বে। ভারতে যাদবপুর প্রেসিডেন্সি জেএনইউ থেকে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড কেমব্রিজ স্পেনের কমপ্লুটেন্সি, অটোনামা, পলিটেকনিক, জার্মানির বার্লিন, মিউনিখ থেকে প্যারিস মেলবোর্ন সব জায়গার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা। আমেরিকার স্ট্যান্ডফোর্ড, MIT, প্রিন্সটন, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হার্ভার্ড সহ আইভি লিগ এর সব বিশ্ববিদ্যালয়। হার্ভার্ড এর ৩৪ টা ছাত্র সংগঠন হার্ভার্ড এর তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে চিঠি দিয়ে প্রতিবাদ জানালো। অন্যদিকে ক্যাম্পাসে হার্ভার্ড এর মূর্তির সামনে টানা অবস্থান চলছে। ক্লাসে ছাত্র ছাত্রীরা প্যালে স তানের স্কার্ফ গলায় ঝুলিয়ে প্রতিবাদ করতে করতে ক্লাস করছে। আমেরিকার পার্লামেন্টে এই নিয়ে আলোচনা হল যে হার্ভার্ড এর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব হলে সারা বিশ্বে কী বার্তা যাবে! আমেরিকায় ই “হুদি লবি প্রচণ্ড স্ট্রং। তারা যা বলবে তা সবাইকে মানতে হবে। হার্ভাডের প্রেসিডেন্টকে বলা হল প্রতিবাদী ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দিতে। এমনকি ব্ল্যাকলিস্ট করে দিতে। হার্ভার্ড বলল ক্যাম্পাসের মধ্যে এটা ওদের বাকস্বাধীনতা। ভিন্ন মতামতের কারণে আমি ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবো না। ওদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারবো না। জেএনইউ এর ছাপ দেখতে পাচ্ছেন? যাইহোক সরকারের ও ই -“হু দি লবির কথা না শোনায় তিন মাসের মধ্যে সেই প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে হয়। তবু হার্ভার্ড পিছিয়ে আসেনি। কর্তৃপক্ষ মিটিং ডাকলো। আলোচনা সভা করল সব প্রফেসর গবেষকদের নিয়ে। আমিও ছিলাম। আলোচনা হল কীভাবে সরকারের অর্ডার কে লঙ্ঘন না করে তারা তাদের DEI ও ক্রিটিক্যাল রেস থিওরি মেনেই চলতে পারে। হার্ভার্ড সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখলো।

প্রশ্ন থেকে যায়, হার্ভার্ড লড়াই করেছে, কিন্তু ছোট ছোট বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুলগুলোর সেই ক্ষমতা কোথায়! হার্ভার্ড তো শুধু একটা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের শিক্ষাগত অবস্থার আয়না। ট্রাম্প সরকারের হুমকিতে তারা যেমন মাথা নোয়ায়নি, তেমনি নিজেদের অবস্থানে অবিচলও থেকেছে। ২০২৫ এও তাই বর্তমান প্রেসিডেন্ট অ্যালান গারবার সোজাসুজি ট্রাম্পকে জানিয়ে দিয়েছেন, “আমরা আমাদের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেব না।” আর তাই ট্রাম্প সরকার ২.২ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড হোল্ডে রেখেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল, যেখানে আমি গবেষণা করতাম। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের গবেষণার একটা বড় অংশ আসে NIH ( National Institute of Health ) এর সরকারি ফান্ড থেকে। এই ফান্ড না এলে প্রচুর গবেষণা মাঝ পথে থেমে যেতে পারে, অনেক প্রফেসর, গবেষক, স্কলারদের স্যালারি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু হার্ভার্ড বলেছে, “আমাদের তো ৪০০০ কোটি ডলারের এন্ডোয়মেন্ট ফান্ড আছে, আমরা মরবো না!” ট্রাম্প ভাবলেন ধমকে-চমকে কাজ হবে, আর হার্ভার্ড চোখে চোখ রেখে বলল, “চলো দেখা যাক!” শিক্ষিত সমাজের মেরুদণ্ড এভাবেই উঁচুতে থাকে উঁচুতে রাখতে হয়। ঠিক যেমন আপনারা দেখেছেন কলকাতায় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের সময়।

এই ঘটনার আসল পাঠটা বড়ই জরুরি – ডানপন্থী সরকারের অযৌক্তিক শর্তসাপেক্ষ ফান্ডের ফাঁদে যদি শিক্ষার স্বর নরম হয়ে যায়, তবে প্রজন্ম সত্যের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলবে। ইতিহাসের যেটুকু অন্ধকার, তা না শেখালে আলোয় পৌঁছানো যায় না। হার্ভার্ডের এই লড়াই শুধু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই নয়, এটা ভবিষ্যতের শিক্ষার জন্য একটা বার্তা, “শিক্ষার মাঠে রাজনীতির ঘুঁটি চলবে না।” আসলে হিসেবটা সোজা – শিক্ষা মানে প্রশ্ন করা, শেখা আর বোঝা। রাজনীতি যদি সেটার রিমোট হাতে নিতে চায়, তাহলে শিক্ষার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। হার্ভার্ড দেখিয়ে দিল, মাথা নত না করেও জেতা যায়! হার্ভার্ড এই কারণেই পৃথিবীর ১ নম্বর বিশবিদ্যালয়। সব দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখা দরকার কীভাবে সরকারের অন্যায় চাপের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু রাখতে হয় শিক্ষার স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে, প্রজন্মের স্বার্থে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button