অপরাধদুর্নীতি

গুরুজির ছদ্মবেশের সাম্রাজ্য: কোয়ান্টামের আড়ালে ভণ্ডামি, দুর্নীতি, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র

বাংলাদেশের প্রান্তিক জনপদ থেকে শুরু করে রাজধানীর প্রভাবশালী মহলেও এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে এক অদ্ভুত নাম – শহীদ আল বোখারী মহাজাতক ওরফে গুরুজী। তার প্রতিষ্ঠিত কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আজ একটি বহুল আলোচিত ও সমালোচিত নাম। কিন্তু জনপ্রিয়তার মুখোশের আড়ালে রয়েছে ভয়ঙ্কর সব তথ্য – ভণ্ডামি, ধর্মীয় বিকৃতি, আর্থিক দুর্নীতি ও রাষ্ট্রবিরোধী মতাদর্শের এক মহাতঙ্কজনক সংমিশ্রণ।

শুরুতেই প্রশ্ন উঠে আসে নাম নিয়ে। “শহীদ”, “আল বোখারী” ও “মহাজাতক” – তিনটি শব্দের এমন অসংগঠিত সমন্বয় ইসলাম ধর্ম বা কোনো সাংবিধানিক নাগরিক পরিচয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তার প্রকৃত নাম কী, সেটি আজও গোপন। তিনি নিজেকে এলএলবি পাশ বলে দাবি করলেও তিনি আদৌ মেট্রিকুলেশন পাশ কি-না, সেই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর মেলেনি।

তার চেহারা এবং পোশাকও সচেতনভাবে নির্মিত এক প্রতীকের মতো। দাড়ি বিহীন বড় গোঁফের চেহারায় সাধারণ সাদা পাঞ্জাবি ও পাজামা পড়ে নিজেকে ‘দরবেশ’ হিসেবে উপস্থাপন করলেও তার অতীত কীর্তি অন্যকথা বলে। একসময় কালো পোশাক পড়ে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, আমলা ও তাদের স্ত্রীদের কাছে পাথরের তৈরি আংটি বিক্রি করে ভাগ্য ফেরানোর নাম করে বিশাল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। আংটির মূল্য কয়েক টাকা হলেও দাম নিয়েছেন কয়েক লক্ষ টাকা পর্যন্ত।

প্রতিটি কোয়ান্টাম মেডিটেশন কোর্সে অংশগ্রহণকারী সংখ্যা এক থেকে তিন হাজার পর্যন্ত। জনপ্রতি রেজিস্ট্রেশন ফি ১১,৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়। এ যাবৎ ৪৯৮টি কোর্স শেষ হয়েছে – যার হিসাব দিলে আয় দাঁড়ায় কয়েকশো কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থ ব্যাংকে সংরক্ষণ করা হয় না। কোথায় যায়, কীভাবে ব্যবহার হয়, কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য এবং হিসাবনিকাশও এ যাবৎ প্রদান করেন নাই।

বান্দরবনের লামায় অসহায় ও গরীব শিশুদের শিক্ষা প্রকল্পের নামে ‘মাটির ব্যাংক’ প্রকল্পটি চালু করা হলেও প্রতিবছর এর আয় দেখানো হয় ৫০ কোটিরও বেশি। অথচ বাস্তবে শিক্ষার্থীদের পিছনে খরচ করা হয় এক-চতুর্থাংশেরও কম। বাকি অর্থ কোথায় যায়, সেটি আজো অজানা। আবার ওই একই প্রকল্পের বিপরীতে তার প্রায় ১০ হাজার মুরিদ ও ভক্তদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা গ্রহন করছেন, যার প্রকৃত হিসাব আজ পর্যন্ত তিনি প্রদান বা উল্লেখ করেন নাই।

কুরআন শরীফের ‘বাংলা মর্মকথা’ নামে তিনি যেটি তৈরি করেছেন, তাতে অনেক ক্ষেত্রেই অর্থ বিকৃত করে দলবদ্ধ ধ্যান সংগঠনে বেশি বেশি দান করার কথা বলা হয়েছে। মুরিদদের প্রতি নির্দেশ, কমপক্ষে ৪০টি কোরআনের মর্মকথা এবং তার মতো করে লেখা হাদীছ ৪০টি বিক্রি ও বিতরণ বাধ্যতামূলক – যেন প্রচার ও বিক্রির মাধ্যমেও বড় অঙ্কের অর্থ আদায় করার মহাোৎসব। তিনি এ ধরনের বিভিন্ন পুস্তক বিক্রয় ও বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছেন তার মুরিদদের প্রতি। মুরিদরা তা অন্ধের মতো পালন করেই চলেছেন।

গুরুজীর অনুসারীরা তার কথাকে শুদ্ধতম নির্দেশ হিসেবে মান্য করেন। কেউ বলেন না, “আল্লাহ বলেছেন” বা “রাসুল (সা.) বলেছেন” – বরং বলেন “গুরুজী বলেছেন”। এমনকি মৃত্যুর পর লামায় কবর দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, “সেখানে কবর দেওয়া হলে কেয়ামত পর্যন্ত কবরের আজাব হবে না।” মৌসুমী কসমেটিকসের মালিক মাহতাবউদ্দিনসহ অনেককে এমনভাবে সেখানে কবর দেওয়া হয়েছে এবং এটা অব্যাহত রয়েছে। সেখানকার পানি পান করলে রোগবালাই হতে রক্ষা পাওয়া যায় মর্মে মুরিদরা বিশ্বাস করেন এবং পানও করেন।

বাংলাদেশ সরকার যখন বলছে, ‘দুই সন্তানের বেশি নয়’, তখন গুরুজী উল্টো বার্তা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, “জন্মনিয়ন্ত্রণ মহাপাপ। যত সন্তান জন্মাবে ততই মঙ্গল। যিনি জীবন দিয়েছেন, তিনিই আহার দিবেন”। এটা রাষ্ট্রীয় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতির বিরুদ্ধে একটি সুপরিকল্পিত প্রচারণা ও কার্যক্রম।

অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে – তিনি হিপনোটাইজ বা সম্মোহিতকরণ ক্ষমতা কৌশলে প্রয়োগ করে তার মুরিদদের মানসিকভাবে দাসে পরিণত করে ফেলেছেন। তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হিলিং অর্থাৎ ‘আশা পূরণ’ এর নামে আদায় করে চলেছেন। এ ধরনের বিভিন্ন পদ্ধতিতে তিনি কোটি কোটি টাকা আদায় করেই চলেছেন। মুরিদরা যেন জ্ঞানার্জন করে ভালোমন্দ উপলব্ধি করতে না পারেন, সেজন্য স্মার্ট মোবাইল ফোন ব্যবহার করা এবং ইউটিউব দেখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছেন।

এখন প্রশ্ন একটাই – এই বিপুল অর্থ ও প্রভাব কোথায় যাচ্ছে? শহীদ আল বোখারী গুরুজী যদি প্রকৃতই নির্দোষ হন, তবে তিনি কেন তার আয়ের হিসাব প্রকাশ করেন না? কেনই বা তার নাম, জন্ম ও শিক্ষাগত যোগ্যতা গোপন রেখেছেন? কেন তার অনুবাদিত কুরআনের মর্মকথা ও হাদীছসহ বিভিন্ন পুস্তক বিতর্কিত, আর কেনই বা তার কথার বিরুদ্ধে যেতে কেউ কথা বলতে এবং প্রশ্ন করতে পারেব না – তার মুরিদরা?

একটি অদৃশ্য সাম্রাজ্যের মুখোশ উন্মোচন এখন জরুরি এবং সময়ের দাবি হয়ে পড়েছে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এবং শহীদ আল বোখারী গুরুজীর কার্যক্রম শুধুমাত্র ধর্মীয় ভণ্ডামিই নয়, এটি অর্থনৈতিক অপরাধ, রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতি বিদ্রোহ এবং এক প্রকার মানসিক দাসত্বের নির্মাতা। একে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। জরুরি ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রতিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

এখন সময় এসেছে মুখোশ খুলে ফেলার – এটি উন্মোচিত হলে শুধু থলের বিড়াল নয়, বেরিয়ে আসবে দুর্নীতির হস্তিদল।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button