অন্যান্য

বাংলাদেশের শ্রম আন্দোলন ও পোশাকশিল্পের সাম্প্রতিক উত্তাল প্রবাহ: একটি বিশ্লেষণ

বিল্লাল বিন কাশেমঃ বাংলাদেশের ইতিহাসে শ্রম আন্দোলন বরাবরই এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কৃষি ও কুটিরশিল্পভিত্তিক অর্থনীতি থেকে যখন দেশের শিল্পায়নের দিকে যাত্রা শুরু হয়, তখন থেকেই শ্রমিকদের অধিকার, ন্যায্য মজুরি, এবং কাজের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। বিশেষ করে স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে পোশাকশিল্পে যে দ্রুত অগ্রগতি ঘটেছে, তা একদিকে যেমন জাতীয় অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে, অন্যদিকে শ্রমিকদের জীবনমান নিয়ে গভীর উদ্বেগও তৈরি করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের আন্দোলন সেই দীর্ঘ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়ই নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

শ্রম আন্দোলনের শেকড়: ইতিহাসের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের শ্রম আন্দোলনের ইতিহাস প্রায় শতবর্ষ পুরোনো। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২০-এর দশকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বস্ত্রশিল্প ও নৌযান শ্রমিকরা প্রথম বড় ধরনের সংগঠিত আন্দোলনে অংশ নেয়। পরবর্তীকালে পাকিস্তান আমলে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানেও শ্রমিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। এই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের পরে শ্রমিক আন্দোলনের চরিত্র নতুন আকার ধারণ করে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বড় বড় শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে, শ্রমিকদের সংগঠিত করার প্রয়াস চলে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত অধিকার প্রাপ্তি তখনও দুর্লভ ছিল।

পোশাকশিল্পের উত্থান এবং শ্রমিক সংকট

১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প দ্রুত বিকশিত হতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক বাজারে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ সমাদৃত হতে থাকে। বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এই খাতে কর্মরত, যাদের প্রায় ৮০ শতাংশই নারী। গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে পোশাকশিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও শ্রমিকদের মজুরি ও কর্মপরিবেশের অবনতি দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।

প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রমিকদের বেতন ছিল অতি সামান্য। ন্যূনতম মজুরি আদায়ে আন্দোলন শুরু হয় নব্বইয়ের দশকেই। তবে ২০১২ সালের তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধস বিশ্ববাসীর চোখে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ন্যায্যতার প্রশ্নকে আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। সেসব ঘটনা আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি এবং কারখানার নিরাপত্তা নিয়ে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।

সাম্প্রতিক আন্দোলনের পটভূমি

২০২3-24 সালের দিকে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে আবারও শ্রমিক আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। মূল দাবি ছিল ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো। শ্রমিকদের বক্তব্য ছিল, বর্তমান বাজার দরের তুলনায় তাদের মজুরি অতিমাত্রায় কম; নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

সরকার নির্ধারিত মজুরি বোর্ড ও মালিকপক্ষের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা সত্ত্বেও শ্রমিকরা তাদের প্রত্যাশিত মজুরি পায়নি। ফলে বিভিন্ন শিল্প এলাকায় ধর্মঘট, বিক্ষোভ, অবরোধ, এমনকি সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন শ্রমিক হতাহত হন। মালিকপক্ষ বেশ কিছু কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়, যা শ্রমিকদের জীবনে অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে তোলে।

আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও নতুন মাত্রা

সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোতে কয়েকটি নতুন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়:

১. বৃহত্তর ঐক্য: শ্রমিকরা আগের তুলনায় বেশি সংগঠিত ছিল। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও তারা প্রচার চালিয়েছে।

২. নারী শ্রমিকদের অগ্রণী ভূমিকা: নারীরা আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন, যা শ্রমিক সমাজে নারীর ভূমিকা ও আত্মবিশ্বাসের নতুন দিক উন্মোচন করেছে।

৩. সুশৃঙ্খল দাবি উত্থাপন: আন্দোলনকারীরা নির্দিষ্ট অংকের ন্যূনতম মজুরি দাবি করেছেন, যেমন ২৩ হাজার টাকা, যা বাস্তবতা ও বাজার দরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

৪. আন্তর্জাতিক সংহতি: বিদেশি শ্রমিক সংগঠন ও ক্রেতারা অনেকাংশে শ্রমিকদের দাবির প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন।

রাষ্ট্র ও মালিকপক্ষের ভূমিকা

সরকার একদিকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করলেও, অন্যদিকে আন্দোলন দমনেও শক্তি প্রয়োগ করেছে। মালিকপক্ষের একাংশ শ্রমিকদের দাবিকে অযৌক্তিক বলে প্রত্যাখ্যান করে এবং উৎপাদন স্থবির হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় কঠোর অবস্থান নেয়।

তবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এখন এমন একটি সময় এসেছে, যখন শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন না করলে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প তার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। সামাজিক দায়বদ্ধতার (CSR) ধারণা বিশ্ববাজারে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

শ্রম আন্দোলন ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ

পোশাকশিল্প বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ জোগান দেয়। এই খাতের ভবিষ্যৎ যে শ্রমিকদের কল্যাণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, তা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও কাজের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত না করলে বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে।

একইসঙ্গে, ডিজিটাল অর্থনীতি ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি-ভিত্তিক প্রশিক্ষণও জরুরি। এটি শ্রমিক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ রূপ নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

আন্দোলনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক

শ্রমিকদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া সত্ত্বেও আন্দোলন চলাকালে সহিংসতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতা কখনো কখনো পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছে। ভাঙচুর বা চরমপন্থী পদক্ষেপ আন্দোলনের যৌক্তিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

অন্যদিকে, শ্রমিকরা নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করছে, যারা কেবলমাত্র ক্ষোভের ভাষা নয়, বরং নীতিগত ও পরিশীলিত আলোচনা ও দাবি-দাওয়ার ভাষা ব্যবহার করছে। এটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের শ্রম আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী ও ইতিবাচক করতে পারে।

সমাধানের পথ

১. ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন: শ্রমিকদের জীবনমানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও নিয়মিত পর্যালোচনা করা।

২. কারখানার পরিবেশ উন্নয়ন: নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও মানবিক কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা।

৩. ত্রিপক্ষীয় সংলাপ: সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে নিরপেক্ষ ও নিয়মিত সংলাপের আয়োজন।

৪. আইনি সুরক্ষা ও অধিকার: শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা এবং হয়রানি বন্ধ করা।

৫. দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি: আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও পেশাগত প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানো।

বাংলাদেশের শ্রম আন্দোলন শুধু একটি শিল্পখাতের দাবি-দাওয়ার বিষয় নয়; এটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ন্যায্যতা ও মানবিক উন্নয়নের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। পোশাকশিল্পের সাম্প্রতিক আন্দোলন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শ্রমিকদের অবমূল্যায়ন করে কোনো দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব নয়।

একটি টেকসই ও মানবিক শিল্পখাত গড়ার জন্য শ্রমিকদের স্বার্থকে কেন্দ্রীয় জায়গায় রাখতে হবে। বাংলাদেশ যে উন্নয়নের যে পথে এগোচ্ছে, সেখানে শ্রমিকরাই হবে সেই পথের প্রকৃত পথিক। তাদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করাই হবে আমাদের দায়িত্ব এবং উন্নয়নের সত্যিকারের মানদণ্ড।

লেখক: কবি, লেখক ও গণসংযোগবিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button