আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস স্বাধীন কণ্ঠের আহ্বান: বিভক্ত বিশ্বের বিপরীতে মুক্ত গণমাধ্যম

বিল্লাল বিন কাশেমঃ আজ ৩ মে, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এই দিবসটি কেবল একটি প্রতীকী বার্তাই নয়, বরং এক গভীর অনুরণন—যেখানে সংবাদ, মতপ্রকাশ এবং তথ্যের প্রবাহ একটি সভ্যতার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে ‘মুক্ত গণমাধ্যম’ শুধুই একটি মৌলিক অধিকার নয়, এটি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা ও উন্নয়নের পূর্বশর্ত। আর যখন বিশ্ব বিভক্ত, তখন একীভূত কণ্ঠে সত্য উচ্চারণ করার দায়িত্ব এসে পড়ে গণমাধ্যমের উপরেই।
মুক্ত গণমাধ্যমের মানে হলো—ভয়ভীতিহীন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, কর্পোরেট স্বার্থহীন এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন। এই স্বাধীনতা শুধু সাংবাদিকদের লেখার স্বাধীনতা নয়, এটি সাধারণ মানুষের জানার অধিকার রক্ষারও অন্যতম হাতিয়ার। কোনো রাষ্ট্র বা শাসন যদি জনগণের ওপর জবাবদিহিতামূলক হয়, তাহলে তার অন্যতম ভিত্তি হলো একটি স্বাধীন, জাগ্রত এবং জবাবদিহিমূলক গণমাধ্যম ব্যবস্থা।
জাতিসংঘের মতে, গণমাধ্যম স্বাধীনতা এমন এক অধিকার যা মানবাধিকার রক্ষার অন্যান্য অধিকারকেও কার্যকর করে। যেমন—মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এমনকি অর্থনৈতিক স্বচ্ছতাও গণমাধ্যমের মাধ্যমে কার্যকর হয়। তাই এই দিনটি আমাদের কাছে কেবল উদযাপনের নয়, আত্মসমালোচনারও।
বর্তমান বিশ্বের চিত্র বড়ই বিচিত্র ও সংকটময়। একদিকে চলছে তথ্যযুদ্ধ, অন্যদিকে মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ। মিয়ানমার, আফগানিস্তান, ইরান, ফিলিস্তিন কিংবা ইউক্রেন—প্রতিটি অঞ্চলে মুক্ত কণ্ঠকে নিস্তব্ধ করার ভয়াবহ প্রয়াস চলছে। সাংবাদিকরা সেখানে কেবল তথ্যদাতা নন, তারা যেন একটি নতুন প্রজন্মের ‘সত্যযোদ্ধা’। ২০২৪ সালেই বিশ্বজুড়ে ৮০ জনের বেশি সাংবাদিক পেশাগত কারণে প্রাণ হারিয়েছেন।
তথ্য নিয়ন্ত্রণ এবং ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেওয়ার মতো নতুন অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে সরকার, কর্পোরেট লবি এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের দ্বারাও। একদিকে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, অন্যদিকে সত্য বলার মানুষদের মুখ বন্ধ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা, হুমকি ও ভয়ভীতি।
বাংলাদেশেও গণমাধ্যমের বাস্তবতা আজ বড়ই উদ্বেগজনক। যদিও দেশে গণমাধ্যমের বিস্তার ঘটেছে, নতুন নতুন অনলাইন পোর্টাল এবং টেলিভিশন চ্যানেল এসেছে, তবে অনেকক্ষেত্রে এর স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত। সাংবাদিকেরা অনেকে এখনো রাজনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাজ করেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (২০১৮) প্রণীত হওয়ার পর থেকে বহু সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন, যার কারণে অনেকেই আত্মসংযম বা আত্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য হয়েছেন। অথচ গণমাধ্যমের উচিত ছিল সরকারের ভুল নীতির সমালোচনা করে জনগণের পক্ষে কথা বলা। রাষ্ট্রের প্রতি ভালোবাসা মানেই অন্ধ সমর্থন নয়; বরং সত্য তুলে ধরার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে উন্নতির পথে ধাবিত করাই দেশপ্রেমের প্রকৃত রূপ।
তবে শুধু রাষ্ট্রকে দোষ দিয়ে দায় এড়ানো যায় না। আমাদের গণমাধ্যমকেও আত্মসমালোচনার দর্পণে দেখতে হবে। অনেকে এখন আর সত্য অনুসন্ধানের চেয়ে ‘বিবৃতি নির্ভর সাংবাদিকতা’ বা ‘উপরের নির্দেশনা মোতাবেক সংবাদ পরিবেশন’কে গুরুত্ব দেন। অনেক গণমাধ্যম কর্পোরেট স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত; কারো পেছনে ‘চাকরি বাঁচানো’, কারো পেছনে ‘বিজ্ঞাপন রক্ষা’ নামক স্বার্থ।
অথচ সাংবাদিকতা পেশা নয়—এ এক দায়িত্ব, এক দায়িত্বশীলতা। সমাজের দর্পণ হিসেবে সাংবাদিককে হতে হবে অকুতোভয়, নিরপেক্ষ ও মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। তথ্য যাচাই না করে সংবাদ প্রচার, মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর হেডলাইন, ট্রোলিং সংস্কৃতি—এসব থেকেও আমাদের মুক্ত হতে হবে।
বর্তমান তরুণ সমাজ এক ডিজিটাল বাস্তবতায় বেড়ে উঠছে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং কনটেন্ট ক্রিয়েশনের এ যুগে সবাই যেন নিজেই সাংবাদিক। এই বাস্তবতা যেমন গণমাধ্যমকে আরও বেশি ‘জনমুখী’ করে তুলেছে, তেমনি বাড়িয়েছে দায়িত্বের মাত্রা। গণমাধ্যমের সত্যতা যাচাই, তথ্যের উৎস নির্ধারণ এবং মানুষের ওপর প্রভাব বিবেচনা এখন আরও জরুরি।
তরুণ সাংবাদিকদের অনেকেই সামাজিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন। তারা পুরনো ধ্যান-ধারণার বাইরে এসে নতুন ভাষা, নতুন কৌশল ও নতুন চেতনাকে ধারণ করছেন। এটিই গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ—যেখানে সাংবাদিকতা হবে সত্য, মানবতা ও দায়বদ্ধতার মিলিত প্রয়াস।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে গণমাধ্যমের স্বরূপ ও প্রভাব বদলাচ্ছে। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (AI), ব্লকচেইন, বিগ ডেটা—এসব প্রযুক্তি যেমন সংবাদ পরিবেশনকে সহজ করেছে, তেমনি ভুল তথ্য ছড়ানোর পথও করে দিয়েছে সুগম। AI-র মাধ্যমে Deepfake ভিডিও, Chatbot দ্বারা তৈরি প্রোপাগান্ডা—এসব নতুন বাস্তবতা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখানে গণমাধ্যমকে হতে হবে প্রযুক্তি-সচেতন, নৈতিকতা-নির্ভর এবং তথ্য যাচাইয়ে দক্ষ। একইসঙ্গে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকে সামনে রেখে ‘মুক্ত তথ্যপ্রবাহ’-এর জন্য সোচ্চার হতে হবে।
আজকের বিভক্ত, সংঘাতময় ও রাজনীতিকভাবে মেরুকৃত বিশ্বে গণমাধ্যম হতে পারে একটি সেতুবন্ধন—যেখানে নানা মত, ভিন্ন ভাষা এবং বিতর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি একত্রে উঠে আসে সত্যের আলোয়। এই কারণে মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য শুধু আইনগত সুরক্ষা নয়, চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সামাজিক সম্মান এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা।
আমরা চাই এমন একটি বিশ্ব, যেখানে একজন সাংবাদিক নিজের সত্যকে নির্ভয়ে তুলে ধরতে পারেন, যেখানে গণমাধ্যম রাষ্ট্র ও জনতার মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করবে, যেখানে সংবাদপত্র হবে ন্যায়ের মুখপত্র, আর সম্প্রচারমাধ্যম হবে মূল্যবোধের বাহক।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে আমাদের একবার নয়, বারবার ফিরে দেখা দরকার—আমরা কোন পথে হাঁটছি। গণমাধ্যম কি সত্যিই মুক্ত, নাকি কেবলমাত্র একটি চতুর্থাংশ স্বাধীনতার মুখোশ পরেছে? আমরা যদি মুক্ত সমাজ, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র এবং মানবিক পৃথিবী গড়তে চাই, তবে আমাদের প্রথম শর্ত হওয়া উচিত—একটি সত্যনিষ্ঠ, দায়িত্বশীল ও স্বাধীন গণমাধ্যম নিশ্চিত করা।
গণমাধ্যম কেবল খবর দেয় না; গণমাধ্যম সমাজের বিবেক, সময়ের সাক্ষী এবং ভবিষ্যতের নির্মাতা। আজকের দিনে এই বার্তাটি ছড়িয়ে যাক—স্বাধীন কণ্ঠের আহ্বান হোক বিভক্ত বিশ্বের বিরুদ্ধে সত্য ও মানবতার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম।
লেখক: কবি, কলামিস্ট ও গণসংযোগবিদ