ডায়াবেটিস রোগীর পায়ে ক্ষত: হালকা থেকে গ্যাংগ্রিন পর্যন্ত হতে পারে

লেখক: ডা. আব্দুল্লাহ আল গাদ্দাফি (রানা), সহযোগী অধ্যাপক
ডায়াবেটিস আজকের দিনে এক নীরব ঘাতক। এটি শুধু রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে না, বরং শরীরের একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ধীরে ধীরে। পা হলো এমনই এক অঙ্গ, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। একটি সাধারণ কাটা, ফোস্কা বা ক্ষতই ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ভয়ানক রূপ নিতে পারে। কখনো কখনো তা গিয়ে দাঁড়ায় গ্যাংগ্রিন পর্যন্ত, যেখানে একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় অঙ্গচ্ছেদ (amputation)। এই লেখায় আমরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত পায়ের গঠনগত পরিবর্তন, উপসর্গ, ইনফেকশনের সতর্ক সংকেত ও করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ক. পায়ের গঠনগত পরিবর্তন
ডায়াবেটিস দীর্ঘমেয়াদে স্নায়ু (neuropathy) এবং রক্তনালী (angiopathy)-কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে পায়ের স্বাভাবিক গঠন ও কার্যকারিতা বদলে যেতে থাকে। কিছু সাধারণ গঠনগত পরিবর্তন হলো:
হ্যামারটো (Hammertoe): আঙুলগুলো বাঁকা হয়ে যায়, ফলে জুতোর সঙ্গে ঘর্ষণ বাড়ে এবং ফোস্কা পড়ে।
চারকোট ফুট (Charcot foot): এটি একটি জটিল অবস্থা, যেখানে পায়ের হাড় দুর্বল হয়ে গিয়ে ভেঙে যেতে পারে এবং পায়ের আকৃতি বিকৃত হয়ে যায়।
পা ফুলে যাওয়া: রক্ত সঞ্চালনের ব্যাঘাতের ফলে পায়ে পানি জমে যায়, যা প্রদাহ ও সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
চর্মের পরিবর্তন: পায়ের ত্বক শুষ্ক হয়ে পড়ে, ফাটে, যা ইনফেকশনের জন্য সহজ প্রবেশদ্বার তৈরি করে।
খ. তাপমাত্রা, রং, দুর্গন্ধ ও ব্যথাহীনতা
ডায়াবেটিস আক্রান্ত পায়ে কিছু লক্ষণ খুব গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত। এগুলোর মধ্যে অন্যতম:
তাপমাত্রার পরিবর্তন: সংক্রমণ বা গ্যাংগ্রিনের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে পা হঠাৎ খুব গরম বা ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে।
রঙ পরিবর্তন: পায়ের চামড়া যদি হঠাৎ লাল, নীলচে বা কালচে হয়ে যায়, তবে এটি রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা বা টিস্যু নষ্ট হওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে।
দুর্গন্ধ: পায়ের ক্ষত থেকে যদি দুর্গন্ধ বের হয়, তবে তা ইনফেকশনের পরিষ্কার লক্ষণ। এটি মৃদু থেকে তীব্র হতে পারে।
ব্যথাহীনতা: অনেক সময় রোগীরা ব্যথা অনুভব করেন না, যা সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ এতে ক্ষত বা সংক্রমণ অনেক দেরিতে ধরা পড়ে।
এই ব্যথাহীনতা ঘটে স্নায়ু ক্ষতির কারণে, যাকে বলা হয় পারিফেরাল নিউরোপ্যাথি। একজন রোগীর পায়ে কাঁচ ঢুকেও তিনি টের পান না—এমন বহু ঘটনা চিকিৎসাজীবনে আমরা দেখে থাকি।
গ. ইনফেকশনের সতর্ক সংকেত
ডায়াবেটিক পায়ে ইনফেকশন একটি জরুরি চিকিৎসাজনিত বিষয়। এর কিছু সতর্ক সংকেত নিম্নরূপ:
১. পায়ের ক্ষত শুকোচ্ছে না বা ধীরে শুকাচ্ছে।
২. ক্ষত থেকে পুঁজ বা রক্ত বের হচ্ছে।
৩. পায়ের আশেপাশে লালচে হয়ে ফুলে যাওয়া।
৪. দেহে জ্বর হওয়া বা দুর্বলতা অনুভব করা।
৫. ক্ষতের আশেপাশে কালো দাগ বা চামড়া মরে যাওয়া – এটি গ্যাংগ্রিনের ইঙ্গিত।
৬. চলা-ফেরায় কষ্ট হওয়া বা ভারসাম্যহীনতা।
এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইনফেকশন যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে, চিকিৎসার সাফল্যের সম্ভাবনাও তত বেশি।
ডায়াবেটিক ফুট প্রতিরোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস:
১. নিয়মিত পায়ের পরীক্ষা: প্রতিদিন পায়ের পাতা, আঙুলের ফাঁক ও গোড়ালি পরীক্ষা করুন। ক্ষত, ফোসকা বা রঙের পরিবর্তন খেয়াল রাখুন।
২. পায়ের যত্ন নিন: পা পরিষ্কার রাখুন, হালকা গরম পানিতে ধুয়ে মৃদু তোয়ালে দিয়ে মুছুন এবং ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন। আঙুলের ফাঁকে লোশন দেবেন না।
৩. নখ কাটা সতর্কভাবে: পায়ের নখ সোজাসুজি কেটে দিন, কোনভাবে কোণাকুণি করে কেটে ফেলে ইনফেকশন সৃষ্টি করবেন না।
৪. সঠিক জুতা পরুন: পায়ের আকার ও আরামের ওপর ভিত্তি করে জুতা পরুন। শক্ত জুতা বা টাইট মোজা এড়িয়ে চলুন।
৫. খালি পায়ে হাঁটা বারণ: ঘরে বা বাইরে খালি পায়ে হাঁটবেন না। পায়ে কাঁটা বা আঘাত লুকিয়ে ইনফেকশনে রূপ নিতে পারে।
৬. রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখুন: ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে পায়ের জটিলতা কমে আসে। প্রয়োজনে ডায়েট ও ওষুধ মেনে চলুন।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
পায়ে ক্ষত বা কাটা জায়গা ৩ দিনের মধ্যে না শুকালে
রক্ত বা পুঁজ বের হলে
পা ফুলে গেলে বা রঙ কালো হয়ে গেলে
হঠাৎ ব্যথাহীন হয়ে গেলে (নিউরোপ্যাথির লক্ষণ)
পায়ে দুর্গন্ধ শুরু হলে
শেষ কিছু কথা:
ডায়াবেটিসের কারণে পায়ের ক্ষত এবং গ্যাংগ্রিন প্রতিরোধযোগ্য, যদি তা সময়মতো শনাক্ত ও চিকিৎসা করা যায়। আমাদের দেশের বাস্তবতায় ডায়াবেটিস সচেতনতায় অনেক ঘাটতি রয়েছে। তাই রোগী, পরিবার এবং সমাজ—সবাইকে নিয়ে একটি সম্মিলিত সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি। প্রতিটি ডায়াবেটিক রোগীর উচিত পায়ের যত্নকে প্রতিদিনকার রুটিনের অংশ হিসেবে দেখা। চিকিৎসা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, সচেতনতাও ঠিক ততটাই অপরিহার্য।
লেখক: সাবেক সহযোগী অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইবনে সিনা হাসপাতাল।