রাজনীতি

বাতিল হচ্ছে ২২ ‘মুক্তিযোদ্ধা’র সনদ-তালিকায় শেখ হাসিনা সরকারের সাত মন্ত্রী এমপিও রয়েছেন:

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক-সহ সাত মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’র অভিযোগ তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের দুই সংসদ সদস্য, একজন বিচারপতি, সাবেক সচিব, আইজিপি, সেনা কর্মকর্তাসহ আরো ১৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির মুক্তিযোদ্ধার তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই শুরু করেছে তথ্য যাচাই-বাছাইকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এসব প্রভাবশালী ব্যক্তির মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও গেজেট বাতিল হবে।

যাঁদের মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও গেজেটসংক্রান্ত নথিপত্র তদন্ত করা হবে, তাঁরা হলেন শেখ হাসিনার সরকারের তিন মেয়াদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান ও টিপু মুনশি এবং সাবেক সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মোজাম্মেল হোসেন।

এ তালিকায় আরো রয়েছেন আওয়ামী লীগের দুই সংসদ সদস্য আমিরুল আলম মিলন ও মীর শওকত আলী বাদশা, সাবেক সচিব খোন্দকার শওকত হোসেন, অতিরিক্ত সচিব তড়িৎ কান্তি রায় ও গোপালগঞ্জের তরুণ কান্তি বালা, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক আইজিপি আবদুর রহিম খান, সাবেক সেনা কর্মকর্তা লে. জেনারেল মোল্লা ফজলে আকবর,ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির, ক্যাপ্টেন আনারুল ইসলাম (মিরপুর ক্যম্প), সাবেক কর কমিশনার ও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের পরিচালক ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শাহ সালাউদ্দিন, ফেনীর শফিকুল বাহার মজুমদার ও সালেহ উদ্দিন চৌধুরী এবং রংপুর আলমনগরের আবদুস সোবহান খান।

গত ১৩ এপ্রিল জামুকার চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজমের সভাপতিত্বে জামুকার ৯৫তম সভা হয়। সেখানে বলা হয়, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ দেশের বিশিষ্ট ২২ ব্যক্তির মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এই ২২ জনের এসংক্রান্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করতে তাঁদের তথ্য-প্রমাশাদি যেমন-তাঁদের আবেদন, তদন্ত প্রতিবেদন, সভার কার্যবিবরণী, গেজেট ও অন্যান্য প্রামাণিক তথ্য সংগ্রহ করে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে চারজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য সেনা সদর দপ্তরের কেন্দ্রীয় রেকর্ডস অফিসে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তথ্য পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের ১৫ দিন সময় দিয়ে নোটিশ প্রদান করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এসব বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব ইসরাত চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ জন্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তথ্য দিতে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে নির্দিষ্ট ফরম প্রকাশ করা হয়েছে। এর বাইরেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং সরাসরি আবেদনেও অনেকে – অভিযোগ দিচ্ছেন। জামুকার গত সভায় এসব আবেদন আমলে নিয়ে কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীসহ দেশের বিশিষ্ট ২২ জন ব্যক্তির মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও গেজেটসংক্রান্ত নথি যাচাই করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই ২২ জনের মধ্যে চারজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা। তাঁদের মুক্তিযুদ্ধকালীন তথ্য-উপাত্ত সেনা সদর কর্তৃপক্ষের কাছে চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তদন্ত শেষে অভিযোগ প্রমাণিত হলে এসব প্রভাবশালী ব্যক্তির মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও গেজেট বাতিল করা হবে।’

জানা গেছে, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক কোথায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং কোথায় যুদ্ধ করেছেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। এ নিয়ে তিনি নিজেও মুখ খোলেননি। বিতর্কটি শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা গেজেট প্রকাশ করে। সেখানে আ ক ম মোজাম্মেল হকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয় খোদ জাতীয় সংসদেও। ২০২৩ সালে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করেন জামুকার সদস্য ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা ফাউন্ডেশনের মহাসচিব খ ম আমীর আলী। মামলা নম্বর ১৫১৪২। রিট মামলায় তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদসচিব, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, জামুকার চেয়ারম্যানসহ (সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক) মোট সাতজনকে আসামি করা হয়।

আদালতে মামলার আবেদনপত্র বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুসন্ধান করে জানা যায়, ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়া ৫১ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম নেই আ ক ম মোজাম্মেল হকের। জাতীয় জাদুঘরে রাখা ১৯৮৬ সালে তৈরি লাল মুক্তিবার্তার ভলিউম ঘষামাজা করে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ রয়েছে।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগ আমলেই শ ম রেজাউল করিম ও ফারুক খানের নামে গেজেট জারি করার পর সমালোচনার মুখে তা আবার যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জামুকার ৭৫তম সভায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাঁর জন্ম ১৯৬২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। সে হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় তাঁর বয়স ১০ বছরের কম ছিল। অথচ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে ন্যূনতম বয়স হতে হয় সাড়ে ১২ বছর। তাহলে রেজাউল করিমকে কিভাবে এই স্বীকৃতি দেওয়া হলো-এই প্রশ্ন ওঠে।

জামুকার ৭২তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের নামে মুক্তিযোদ্ধার গেজেট জারি হয়। তাঁর স্বীকৃতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় জামুকা এ বিষয়ে সেনা সদরের মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে তা থেমে যায়।

ফারুক খানের বিষয়ে জামুকার তৎকালীন একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘তাঁর বিষয়ে আপত্তি দিলেও অন্য সদস্যরা আমলে নেননি। উনি ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলে ইতিবাচক মতামত দেওয়া হয়। অথচ ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ২৩ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ন ভারতীয় সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ওই ব্যাটালিয়নে ফারুক খান ছিলেন। নিজে বাঙালি অফিসার পরিচয় দিয়ে কোনোমতে প্রাণে রক্ষা পান। ভারতীয় সেনারা ১৫ ডিসেম্বর তাঁকে দিল্লি পাঠান। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ফারুককে কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনার হোসেন আলীর দপ্তরে পাঠানো হয়। এরপর ১৪ জানুয়ারি বেনাপোল বন্দর দিয়ে তিনি বাংলাদেশে আসেন। তাহলে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করলেন কখন?’

বিভিন্ন সরকারের আমলে পাঁচবার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করা হয়েছে। ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় কমিটি এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশ করে।১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের করা তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার ৮৯২। ১৯৯৪ সালে করা তৃতীয় তালিকায় ৮৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধা অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল থেকে চতুর্থ তালিকায় এক লাখ ৫৪ হাজার ৪৫২ জনের নাম মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয়।
(সংগৃহীত::৩০এপ্রিল -২০২৫)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button