কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

২ বছরের যুদ্ধের প্রস্তুতি ইরানের
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, আইএইএ-কে হুমকি দিয়েছে ইরান। সেই সাথে তেহরানের প্রতিনিধি বলেছেন, ইসরাইলের সাথে যুদ্ধ দুই বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
ইরানের গণমাধ্যম জানিয়েছে, জাতিসংঘে ইরানের প্রতিনিধিদল সোমবার একটি বিবৃতি জারি করে বেশ কয়েকটি দেশকে হুমকি দিয়েছে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসিকেও সতর্ক করেছে তেহরান।
‘নিঃসন্দেহে, ইরানে নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মৃত্যু এবং গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংসের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইসরাইলি সরকার এবং আইএইএ-র মহাপরিচালক সম্পূর্ণ দায় বহন করবেন,’ ইরানি প্রতিনিধির বার্তায় বলা হয়েছে।
ইরানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন, দেশটি ইসরাইলের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, দেশটির অনুমান এই যুদ্ধ দুই বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের হামলা
কাতারের আল উদেইদ মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে ইরান। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় এ হামলা চালানো হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)। এদিন ইরানের হামলার ভয়ে কাতারে অবস্থানরত মার্কিনিদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল ওয়াশিংটন। এ সতর্কতার পর কাতার নিজের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়। এরপর ইরানের পক্ষ থেকে এ হামলা চালানো হয়।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় তিনটি পরমাণু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর গতকাল ইসরাইলে ভয়াবহ হামলা চালায় ইরান। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিশোধও নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল তেহরানের পক্ষ থেকে। পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইসরাইলও। দেশটি ফোরদো পরমাণু স্থাপনাসহ ইরানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হামলা চালিয়েছে। সূত্র: তাসনিম নিউজ এজেন্সি, বিবিসি ও আলজাজিরা।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্থাপনায় হামলা হতে পারেÑএমন শঙ্কার মধ্যেই গতকাল রাতে কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায় ইরান। আইআরজিসি জানায়, সোমবার সন্ধ্যায় ‘বিজয়ের প্রতিশ্রুতি’ নামক একটি অভিযানে কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে বিধ্বংসী এবং শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। এই ঘাঁটিটি মার্কিন বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর এবং পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে মার্কিন সন্ত্রাসী বাহিনীর বৃহত্তম কৌশলগত সম্পদ।
এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে কাতার। বলছে, এ হামলা দেশটির সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি বলেন, এ হামলা কাতারের সার্বভৌমত্ব, আকাশসীমা এবং জাতিসংঘ সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কাতার রাষ্ট্র হিসেবে, এ প্রকাশ্য আগ্রাসনের জবাবে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় সরাসরি জবাব দেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে। কাতারের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানের এ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই হামলা সফলভাবে মোকাবিলা করেছে।
তবে ইরান বলছে, এ হামলা ভ্রাতৃপ্রতিম কাতারের বিরুদ্ধে নয়। দেশটির সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল বিবৃতিতে বলেছে, ইরান কাতারে মার্কিন বিমানঘাঁটিতে হামলা করেছে। এ আক্রমণ কোনোভাবেই কাতার বা তার জনগণের জন্য কোনো বিপদ ডেকে আনেনি। কাতারের সঙ্গে উষ্ণ ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ইরান। ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যবহৃত বোমার সংখ্যার সমানসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে এই হামলায়।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, তারা ১৪টি বোমা দিয়ে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে।
কাতারে মার্কিনঘাঁটি আক্রান্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগন জানিয়েছে, কাতারের আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ইরান স্বল্প ও মধ্যম পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছে।
একজন মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নাগরিকের হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। পরিস্থিতি এখনো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
ইরানের এ হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কুয়েত সাময়িকভাবে তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। সিরিয়ায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি কাসরাককে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে আর বাহরাইনজুড়ে সাইরেন বাজানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশজুড়ে সাইরেন বাজানো হয়েছে এবং বাসিন্দাদের নিকটস্থ নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
গতকাল সকালে ইসরাইলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায় ইরান। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ স্থাপনাও। ইসরাইল জানিয়েছে, মধ্য, দক্ষিণ এবং উত্তর ইসরাইল লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। হামলায় দক্ষিণাঞ্চলে একটি জ্বালানি কোম্পানির স্থাপনার কাছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফলে এই অঞ্চলের প্রায় আট হাজার মানুষ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
ইসরাইলি পুলিশ জানিয়েছে, দক্ষিণ ইসরাইলের খোলা জায়গায় ক্ষেপণাস্ত্র পড়ার খবর আমরা পেয়েছি। এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
আইআরজিসি জানিয়েছে, তারা ইহুদিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সর্বশেষ প্রতিশোধমূলক হামলায় সোমবার প্রথমবারের মতো বহুমুখী খাইবার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে।
অন্যদিকে ইরানের ছয়টি বিমানবন্দরে হামলা চালিয়ে ১৫টি যুদ্ধবিমান ধ্বংসের দাবি করেছে ইসরাইল। দেশটির সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা ইরানের ছয়টি বিমানবন্দরে হামলা চালিয়ে ১৫টি বিমান ধ্বংস করেছে। পাশাপাশি এই হামলায় রানওয়ে ও ভূগর্ভস্থ বাংকারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) বলেছে, পশ্চিম, পূর্ব ও মধ্য ইরানে অবস্থিত এসব বিমানবন্দরে তারা ড্রোন হামলা চালায়।
তাদের দাবি অনুযায়ী, ধ্বংস হওয়া বিমানগুলোর মধ্যে রয়েছে এফ-১৫ এবং এফ-৫ যুদ্ধবিমান, একটি রিফুয়েলিং প্লেন এবং একটি এএইচ-১ কোবরা অ্যাটাক হেলিকপ্টার।
তেহরানের এভিন কারাগার ও বাসিজ মিলিশিয়া সদর দপ্তরেও হামলা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরাইল। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ জানান, তাদের টার্গেটে বাসিজের সদর দপ্তর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এভিন কারাগারকেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
ইরসাইলি হামলার কারণে বিদ্যুৎবিভ্রাটের মুখোমুখি হন উত্তর তেহরানের বাসিন্দারা। পরবর্তী সময়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে সঞ্চালন লাইন মেরামত করে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়।
এ ছাড়া ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে তেল আবিব। আইডিএফ জানায়, ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালানো হয়েছে। ওই স্থাপনায় প্রবেশের পথগুলো বাধাগ্রস্ত করার জন্য এটি করা হয়েছে।
হামলার মধ্যে গতকাল সোমবার একটি ইসরাইলি ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি করেছে ইরান। হার্মিস-৯০০ ড্রোনটি ভূপাতিত করার ফুটেজও প্রকাশ করেছে ইরানের গণমাধ্যম। আইআরজিসি জানায়, সোমবার ওই ড্রোন ভূপাতিত করা হয়।
এদিন ইরানের শিক্ষা ও গবেষণাবিষয়ক উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাঈদ খাতিবজাদে বলেছিলেন, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাবে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে, সে সিদ্ধান্ত ইরান নিজের মতো করেই নেবে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে ইরানের হামলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কখন, কীভাবে এবং কোনো মাত্রায় আমেরিকানদের জবাব দেওয়া হবে, সে সিদ্ধান্ত ইরান নেবে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ইসরাইলকে হুমকি দিয়ে বলেন, জায়নিস্ট শত্রু (ইহুদি শত্রু) একটি বড় ভুল করেছে, একটি বড় অপরাধ করেছে। তাকে শাস্তি পেতে হবে। শাস্তি পাচ্ছে, এখনই তাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার পর বিশ্বজুড়ে মার্কিন নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করে বলে, বিদেশে মার্কিন নাগরিক ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বিশ্বের যেখানেই থাকুন না কেন, মার্কিন নাগরিকদের অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এরপর কাতারে অবস্থানরত মার্কিনিদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার পরামর্শ দেয় ওয়াশিংটন। দোহায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বিবৃতিতে বলে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। এই সতর্কতার পর নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয় কাতার। দোহা বলেছে, সাম্প্রতিক ঘটনাবলির আলোকে এ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
হামলা সামলানোর মধ্যেই মোসাদ সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে ইরান। ইরানের বিচার বিভাগবিষয়ক সংবাদ সংস্থা মিজান জানিয়েছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আমিন মাহদাভি শায়েস্তে। তিনি ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের অধীন একটি সাইবার টিমের প্রধান। যিনি সজ্ঞানে ইহুদি রাষ্ট্রের সন্ত্রাসী-গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন।