দাদনের বেড়াজালে ভাগ্য ফিরে মধ্যস্বত্বভোগীদের, সর্বশান্ত জেলেরা

মুহাম্মদ জুরাইরঃ প্রতিকূল আবহাওয়ার ও প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সমুদ্রে যুদ্ধ করে ইলিশ ধরেন জেলেরা। বিপরীতে লাভের অংশের কিছুই পান না তারা। বরং দাদনের টাকা শোধ দিতেই জীবন যায় তাদের। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে দিনে দিনে ইলিশের দাম হয়েছে আকাশচুম্বী।
চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূল পতেঙ্গার, হালিশহর, কাট্টলি, সীতাকুন্ডের ঘাটগুলোতে প্রতিদিন আসে ট্রলারভর্তি ইলিশ । সেখান থেকে পাইকাররা কিনে নেন শত শত মণ মাছ। তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে খুচরা বিক্রেতারা দাম হাঁকান ইচ্ছামতো। এভাবে তিন-চার হাত বদল হয়ে কেজিতে মাছের দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
প্রতিদিন ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মাছ ধরার পড়লেও দাম কেন নাগালের বাইরে— এমন প্রশ্নের উত্তরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না ইলিশ ও সামুদ্রিক মাছের দাম।
সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলে ভোবন নাথ বলেন, আমরা সারা বছর গভীর সমুদ্রে জীবনবাজি রেখে রোদ, বৃষ্টি, ঝড় ও বন্যার মধ্যে মাছ ধরি। কিন্তু এত কষ্ট করেও আমরা ন্যায্য দাম পাই না। আড়তদার, পাইকার, খুচরা বিক্রেতা— এ রকম তিন-চারটি ধাপ যদি না থাকত, তাহলে সরাসরি কাস্টমারদের কাছে মাছগুলো বিক্রি করতে পারতাম। তাহলে আমরা অনেক লাভবান হতাম। কিন্তু দাদনের বেড়াজাল ছিঁড়ে সাধারণ জেলেরা কোনোদিন বের হতে পারেন না।
জাল ও নৌকাসহ মাছ ধরার সব সরঞ্জাম কেনার জন্য আমরা জেলেদের ৫০ হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়ে থাকি। এটাকে আমরা আঞ্চলিক ভাষায় দাদন বলি। এই দাদনের বিনিময়ে আমরা তাদের কাছ থেকে মাছ অনুযায়ী কমিশন দিই।
সূত্র বলছে, দাদন চক্র মৌসুমের আগেই দাদন দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজার নষ্ট হচ্ছে, এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিযোগিতা আইনের আওতায় প্রতিযোগিতা কমিশনও দাদনদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
দাদনের এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ইলিশ আসলে কঠিন একটা চক্রে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছে। দাদনের চক্র নিয়ে গবেষণা হওয়া এবং এই চক্রকে ধরা দরকার। কিছু মানুষের কারসাজিতে ইলিশের দাম বাড়ছে, যার পুরোটাই নিয়ে নিচ্ছে দাদনের চক্র; অথচ হতদরিদ্র জেলেরা সামান্যতম মূল্যও পান না।
অনুসন্ধান আরো বলছে, মাছ ব্যবসায়ীরা শুধু ইলিশ না, অন্য সব মাছের ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়ায় দাদন দিচ্ছেন। দাদনের বিষয়টি নিয়ে কেউ কোনো দিন প্রশ্ন তোলেনি।
চট্টগ্রামে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মৎস্য ব্যবসায়ী বলেন, আড়তদারেরা কোটি কোটি টাকা দাদন দেন, কারণ আগে থেকে পুঁজি বিনিয়োগ না করলে মোকামমালিক (স্থানীয় আড়তদার) বা পাইকারেরা মৌসুমের সময় মাছ দেন না।’
দাদনের আইনি কোনো ভিত্তি না থাকলেও যুগের পর যুগ ধরে এই প্রথা চলে আসছে—মন্তব্য করে বোট মালিক মহীউদ্দীন বলেন, ‘মাছ ব্যবসায়ীরা শুধু ইলিশ না, অন্য সব মাছের ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়ায় দাদন দিচ্ছেন। দাদনের বিষয়টি নিয়ে কেউ কোনো দিন প্রশ্ন তোলেনি।’
ইলিশ গবেষক ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ইলিশের ক্ষেত্রে ৪-৫ ধাপের ব্যবসায়ীরা একে অন্যকে দাদন দিচ্ছে এবং সেই দাদনের বিনিময় শর্ত হচ্ছে, দাদন প্রদানকারীদের কাছেই মাছ বিক্রি করতে হবে; উপরন্তু কমিশনও দিতে হবে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, টাকা ধার দেওয়ার মাধ্যমে তারা সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। সুতরাং এই আইনের বরখেলাপ হচ্ছে এবং এই আইন অনুযায়ী লেনদেনের (দাদন) প্রক্রিয়া অবৈধ হয়ে যাচ্ছে।